গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদে থাকা সাংবিধানিক সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদনে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে তাদের মধ্য মতভিন্নতা আছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে, সাংবিধানিক আদেশে সংস্কার কার্যকরের পর তা গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে। সংসদ নির্বাচনের দিন একসঙ্গে এই গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তৃতীয় দফার সংলাপ হয়। সেখানে কমিশন সর্বশেষ এই প্রস্তাব দেয়।
এতদিন গণভোটের বিষয়ে আগ্রহ না থাকলেও গতকাল বিএনপি গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা চায় সংস্কার বাস্তবায়নে পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন করা হবে এবং পরে তা গণভোটে দিয়ে জনমত যাচাই করা হবে।
জামায়াতে ইসলামী সংসদ নির্বাচনের আগে এই গণভোট চায়। এনসিপি গণভোটের বিষয়ে মতামত দেয়নি। তারা সংস্কার বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশের পক্ষে।
এখন এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় দিয়ে কমিশন সংলাপ মুলতবি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শেষে দেশে ফেরার পর আগামী মাসের প্রথম দিন শেষ দফার সংলাপ হবে। কমিশন জানিয়েছে, ঐকমত্যের জন্য এ সময় তারা দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাবে।
কমিশনের প্রস্তাবে সংবিধান আদেশ, গণভোট
গত ১১ সেপ্টেম্বর ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করে তা স্বাক্ষরের জন্য সংলাপে অংশে নেওয়া রাজনৈতিক দল এবং জোটকে দিয়েছে। সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল একমত হয়েছে। ১১টি প্রস্তাবে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, দুদকের নিয়োগ পদ্ধতিসহ ৯টি সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। দলটি জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তারা এগুলো বাস্তবায়ন করবে না।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল সংস্কার বাস্তবায়ন চায় নির্বাচনের আগে। তারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিও চায়। তবে সংবিধান সংশোধন করতে হবে না–এমন সংস্কারগুলোর নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নে দলগুলো একমত হয়েছে।
জট খুলছে না সংবিধান সংশোধন করতে হবে এমন সংস্কারগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে। বিএনপির অবস্থান সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব না। জামায়াত, এনসিপিসহ বেশি সংখ্যক দল নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক আদেশে সংস্কার বাস্তবায়ন চায়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনে সাংবিধানিক আদেশ জারির পক্ষে মতামত দিয়েছে। গতকাল সংলাপে এই প্রস্তাব তোলে কমিশন। এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ ২০২৫-এ মূল সংস্কারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ (কনস্টিটিউশনাল অর্ডার) জারি করতে পারে। এ আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। এতে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে। জনগণের অনুমোদন পেলে তা জারির তারিখ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত সরকারের কাছে পাঠানো হবে জানিয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতে ছয়টি পদ্ধতি আসে। বিশেষজ্ঞরা চারটি পদ্ধতি দিয়েছেন। সংবিধান সংস্কারে সংবিধান আদেশ ও গণভোটের পরামর্শ দিয়েছে। অনেক দল একে সমর্থন করেছে। কেউ কেউ এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে এবং ভিন্নমতও প্রকাশ করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে পারে কিনা–এ বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রস্তাব একাধিক দল দিয়েছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দলগুলো এ বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা করতে পারে।
নানা দলের নানা মত
সনদের আইনি ভিত্তি দিতে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়াকে ভালো বিকল্প বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। সংলাপে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সকলের সমর্থিত। তাহলে সরকার কেন মতামত নিতে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে না?
জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী, সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ঘোষণাপত্রের ২৫ দফায় বলা আছে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদই সাংবিধানিক সংস্কার করবে। ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদেও একই কথা বলা হয়েছে। ঘোষণাপত্র এখনও কার্যকর নয়; যা কার্যকর নয়, তার ক্ষমতাবলে কীভাবে সাংবিধানিক আদেশ জারি হবে–এমন প্রশ্ন তুলে সালাহউদ্দিন আহমেদ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের মতামত গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, সাংবিধানিক আদেশ বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব কিনা, তা স্পষ্ট করতে হবে।
সংলাপে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন ভালো। যে দল বা জোট জয়ী হবে, তাদের পক্ষেই গণভোটের রায় আসবে। কিন্তু যেসব সংস্কার প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলো সংসদে পাস হলে পরবর্তী সময়ে গণভোট ছাড়া তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই একাধিক গণভোট করার চেয়ে, নির্বাচনের পর একবারেই গণভোট করা ভালো।
আদালতের মতামত নেওয়ার বিরোধিতা করে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন হচ্ছে। সেখানে থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। আবার কেউ কেউ পদ পেতে প্রভাবিত হতে পারেন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ সমাধান নয়। সংসদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করতে পারবে না, তাই নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া উচিত।
দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা জানিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, এনসিপি আদালতের মতামত নেওয়ার বিপক্ষে। এতে জুলাই সনদ আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বোত্তম পন্থা গণপরিষদ।
অবশ্যই গণভোট নিতে হবে: বিএনপি
সংলাপ শেষে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদে এমন অনেক সংস্কার প্রস্তাব আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য অবশ্যই গণভোট লাগবে। তবে গণভোট সংসদ নির্বাচনের পরে করতে হবে। মৌলিক বিষয়ে সংশোধনী আসবে বলে রাষ্ট্রপতির সইয়ের আগে অবশ্যই রেফারেন্ডাম (গণভোট) নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক নাকি বিপ্লবী–গতকালের সংলাপে এই বিতর্কও হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথের আগে রাষ্ট্রপতি ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের মতামত নেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া তিনি এমন মতামত নিতে পারেন না। শেখ হাসিনার পতনের পর রাষ্ট্রপতি কার পরামর্শে মতামত নিয়েছিলেন এ প্রশ্ন তোলে এবি পার্টি। দলটির অভিমত, এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক নয়, বরং গণঅভ্যুত্থানে গঠিত। এই বক্তব্যকে সমর্থন করে জামায়াত ও এনসিপি।
সংলাপের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতি কার পরামর্শে মতামত চেয়েছেন–সুপ্রিম কোর্ট তো এ প্রশ্ন তোলেননি। ফলে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন নেই। জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ আইন। এই আইন বলে আদালত মতামত দিয়েছেন।
একই আইন বলে সরকার সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে পারে কিনা–এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই জন্যই ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের মতামত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আদালতই বলুক, সরকার তা পারবে কিনা। তিনি বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সমাধানের জন্য প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছি। একমত হলে অসাংবিধানিক পদ বন্ধ হবে। সনদের জন্য নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখলে ফ্যাসিবাদীরা লাভবান হবে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারায় সাংবিধানিক আদেশের বিরোধিতা করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, সবই হবে। হয়েছে নয়। যা হয়নি, তার ক্ষমতা বলে কিছু করা যায় না।’
আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় পিআরের দাবিতে জামায়াতসহ ৭ দলের যুগপৎ আন্দোলনকে স্ববিরোধী বলে আখ্যা দেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিএনপি রাজনৈতিক বক্তব্যের জবাব রাজনৈতিক বক্তব্যেই দেবে।
জামায়াতের প্রশ্ন, বিএনপি কেন ঘোষণাপত্র মানছে না
গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর একে অপূর্ণাঙ্গ বলেছিল জামায়াত। কার্যকরের সময় উল্লেখ না থাকায় সমালোচনা করেছিল। বিএনপি অভিনন্দন জানিয়েছিল। হামিদুর রহমান আযাদ সংলাপের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা জুলাই ঘোষণাপত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিল, তারা এখন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি মানছে না কেন?’
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি বলেন, ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, জুলাই সনদ বিরোধীরা প্রত্যাখ্যাত হবে। সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার কার্যকর করে নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। তারপর সংসদ নির্বাচন হবে। গণভোট আয়োজন করতে সর্বোচ্চ ১৫ দিন লাগবে। নির্বাচনের এখনও পাঁচ মাস বাকি।
গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব জনগণের অনুমোদন না পেলে কী হবে–এমন প্রশ্নে জামায়াতের আরেক সহকারী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান জানান, জনগণ প্রত্যাখ্যান করলে বিনাপ্রশ্নে মেনে নেব।
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার বিরোধিতা করে জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান বলেন, আদালতকে বিতর্ক মুক্ত রাখতে সংলাপে ঐকমত্য হয়েছে। তাহলে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কেন আদালতে যাব? সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ভুল ছিল।
হামিদুর রহমান নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, অতীতে সংসদের পাস করা সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী টেকেনি মৌলিক কাঠামো পরির্বতন হয়েছিল বলে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের এখতিয়ার সংসদের নেই। সে কারণে জিয়াউর রহমানের মতো সাংবিধানিক আদেশে সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধন করে, তা গণভোটে অনুমোদন নেওয়াই ভালো পন্থা।
গণঅধিকারের পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির আবদুল হক সানীও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং নির্বাচনের আগে গণভোট চান।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার।