কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা সেবা বন্ধ করেছে ভারত। কানাডায় একজন শিখ নেতাকে হত্যার ঘটনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এমন পদক্ষেপ আসলো।
ভিসা সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান বিএলএস ভারতীয় মিশন থেকে একটি বার্তা পোস্ট করে জানিয়েছে, ‘পরিচালনা সংক্রান্ত কারণে’ এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে শিখ নেতা হারদিপ সিং নিজ্জার হত্যার পেছনে ভারতের সম্পৃক্ততার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তদন্ত করে দেখছে কানাডা – এমন মন্তব্যের পর দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ভারত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওই অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা দুই দেশের খারাপ সম্পর্ক এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
ভিসা বন্ধ করার খবর বিএলএস এর ওয়েবসাইটে প্রথম বৃহস্পতিবার পোস্ট করে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, “ভারতীয় মিশনের গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ: পরিচালনা সংক্রান্ত কারণে, পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত ভারতীয় ভিসা সেবা বন্ধ থাকবে। এ ব্যবস্থা ২১শে সেপ্টেম্বর থেকেই কার্যকর হবে।”
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি এবং তিনি বিবিসিকে বিএলএস এর ওয়েবসাইটের বরাত দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
কানাডায় অবস্থানরত বা ভ্রমণকারী ভারতীয় নাগরিকদের এক নির্দেশনায় ‘সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন’ করার পরামর্শ দেয়ার একদিন পর এই পদক্ষেপ আসলো।
ওই নির্দেশনায় অভিযোগ করা হয়, “কানাডায় ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে হেইট ক্রাইম এবং অপরাধমূলক সহিংস কার্যক্রম বাড়ছে।”
কানাডায় প্রায় ১৪ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ রয়েছেন।
দুই হাজার ২১ সালের এক জরিপ অনুযায়ী কানাডার মোট জনসংখ্যার তিন দশমিক সাত শতাংশ মানুষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
এরপর ২০২২ সালে কানাডায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পাঠিয়েছে ভারত, সংখ্যায় সেটি প্রায় তিন লাখ ২০ হাজার। এই সংখ্যা কানাডার মোট বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ।
গত বুধবার কানাডায় থাকা বা ভ্রমণকারী ভারতীয় নাগরিকদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়।
দিল্লি বলছে, সম্প্রতি তাদের কূটনীতিক এবং “ভারত বিরোধী কর্মসূচী সমর্থন করে না এমন ভারতীয়”দের লক্ষ্য করে হুমকি দেয়া হয়েছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সোমবার বলেন, কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জার এর হত্যাকাণ্ডে ‘ভারত সরকারের গুপ্তচরেরা’ জড়িত কিনা তা তদন্ত করে দেখছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা।
মি. সিংকে ২০২০ সালে সন্ত্রাসী ঘোষণা করে ভারত।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় গত ১৮ই জুন একটি শিখ মন্দিরের বাইরে মুখোশ পরা দুই জন বন্দুকধারী নিজের গাড়িতে গুলি করে হত্যা করে নিজ্জারকে।
সোমবার কানাডার পার্লামেন্টে মি. ট্রুডো বলেন, “কানাডার মাটিতে কানাডার কোন নাগরিকের হত্যাকাণ্ডে বাইরের কোন সরকারের জড়িত থাকাটা আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন যা অগ্রহণযোগ্য।”
ভারত এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, কানাডা “খালিস্তানি সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থীদের ওপর থেকে নজর ঘুরানোর” চেষ্টা করছে, যাদেরকে সেখানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকা শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খালিস্তান বা শিখদের জন্য আলাদা দেশের দাবির বিরুদ্ধে বরাবরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত সরকার।
ভারতে খালিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল ১৯৮০ এর দশকে। সেসময় শিখ-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব রাজ্যে একটি সহিংস বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
শক্তি প্রয়োগ করে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল এবং ভারতের এর এখন আর খুব বেশি দাপট নেই। তবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের কিছু শিখ ডায়াসপোরা সম্প্রদায়ের মধ্যে এটির এখনো জনপ্রিয়তা আছে।
পাঞ্জাবের বাইরে কানাডায় সর্বোচ্চ সংখ্যক শিখ বসবাস করেন।
দেশটিতে প্রায় সাত লাখ আশি হাজার শিখ রয়েছে যারা কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ।
সেখানে খালিস্তানের পক্ষে বিক্ষোভ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত জুনে, ভারত নিজেদের কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে কানাডার কাছে “একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ” দায়ের করেছিল।
সম্পর্কে উত্তেজনা
চলতি সপ্তাহের সোমবার কানাডার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, “কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের গুপ্তচরদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কানাডার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে।
পার্লামেন্টের ভাষণে তিনি বলেন, “কানাডার গভীর উদ্বেগের কথা ভারত সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মধ্যে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছি।”
মূলত মি. ট্রুডোর ওই বক্তব্যের পরই দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বিষোদগার আর ব্যবস্থা গ্রহণের পালা শুরু হয়।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয় যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে একেবারে শুরুর দিনই।
মি. ট্রুডোর ওই ভাষণের পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জলি ঘোষণা করেন যে এক শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ওই কূটনীতিক পবন কুমার রাই ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সি আর এন্ড এ ডব্লিউয়ের অফিসার।
এর পরে মঙ্গলবারই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক ডেকে পাঠায় দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকে-কে।
কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়।
মি. নিজ্জারকে হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে দিল্লি ‘মনগড়া’ এবং ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে নাকচ করে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী মঙ্গলবার টুইট করে লেখেন, “এই ধরণের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়া চলছে।“
সম্প্রতি জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী।
তবে ওই শীর্ষ সম্মেলনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করার কারনে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা আরও বেড়ে যায়।
দেখা গেছে যে শীর্ষ সম্মেলনের সময় মি. ট্রুডো নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে করমর্দন করেই দ্রুত সেখান থেকে সরে যান।
এরপর জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে কানাডায় খালিস্তানপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যকলাপের বিষয়টি উত্থাপন করেন নরেন্দ্র মোদী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয় যে বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মি. মোদী।
তবে জাস্টিন ট্রুডো বলেন যে কানাডা সবসময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে।
তার মতে, এটি এমন একটি বিষয় যা কানাডার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার সহিংসতা প্রতিরোধ এবং বিদ্বেষ কমাতেও কানাডা সবসময়েই প্রস্তুত। তার কথায়, “এটাও মনে রাখতে হবে যে, কিছু ব্যক্তির কর্মকাণ্ড সমগ্র কানাডিয়ান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না।“
জি টুয়েন্টি সম্মেলন থেকে ফেরার সময়ে মি. ট্রুডোর বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান নামের যে বিশেষ বিমানটি ব্যবহার করেন, সেটিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিতে চেয়েছিল ভারত।
তবে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কানাডা।
দুদিন দিল্লিতে অপেক্ষা করতে হয় জাস্টিন ট্রুডোকে। আর তিনি দেশে ফেরার পরেই কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজির এক মুখপাত্র জানান, যে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তা স্থগিত করা হচ্ছে।
এদিকে, কানাডা আর ভারতের এই উত্তেজনা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোও শংকিত হয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো চাইছেন যে কানাডার মিত্র দেশগুলি এ ঘটনায় তাদের পাশে দাঁড়াক। এর মধ্যে রয়েছে কমনওয়েলথ ছাড়াও কানাডা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, অর্থাৎ নেটো এবং জি-৭-এর সদস্য।
মি.ট্রুডো চান এই দুটি গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে আনা তাদের অভিযোগগুলি গুরুত্ব সহকারে দেখুক।
ভারত জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে যে এটি কানাডায় ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দেওয়ার ইস্যু থেকে মনোযোগ ঘোরানোর জন্য করা হচ্ছে।