বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দিনে প্রশিক্ষণ আর রাতে জঙ্গিবাদী বয়ান দিতেন মহিবুল্লাহ: পুলিশ

দিনে প্রশিক্ষণ আর রাতে জঙ্গিবাদী বয়ান। আর এ বয়ানে নেতৃত্ব দিতেন জামাতুল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নায়েবে আমির মো. মহিবুল্লাহ।

তার দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে এ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে ৫০ থেকে ৬০ তরুণ। মহিবুল্লাহকে গ্রেফতারের পর এমনটাই জানিয়েছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি)।

বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে সংগঠনের নায়েবে আমির মো. মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলার শায়েখকে (৪৮) গ্রেফতার করে সিটিটিসি।

আর শামীম মাহফুজ উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র মূলনেতা। তিনি সংগঠন পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এর মধ্যে ডা. শাকের গ্রেফতার হয়েছেন বলে জানান তিনি।

সিটিটিসির ইনভেস্টিগেশন টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে; এসময় তার হেফাজত থেকে ২টি মোবাইল ফোন ও ১টি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।

সিটিটিসি বলছে, শায়েখ মহিবুল্লাহ উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আধ্যাত্মিক নেতার ভূমিকা পালন করছিলেন। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে তিনি ব্যাপক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। প্রথম দিকে হিজরতকারীদের তিনিই আশ্রয়-বয়ান দিয়ে বিভ্রান্ত করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঢাকা হয়ে পাহাড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ডা. শাকেরসহ অন্য কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেফতারের পর গা ঢাকা দিতে রাজধানীতে অবস্থান নেন মহিবুল্লাহ।

তিনি বলেন, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সিটিটিসির হাতে গ্রেফতার সংগঠনটির সুরা সদস্য ডা. শাকের ওরফে শিশির, পলাতক জঙ্গি নেতা শামিম মাহফুজসহ গ্রেফতার শায়েখ মহিবুল্লাহ বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যান।

এসময় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কুকি-চীনদের বিদ্রোহী সংগঠন কেএনএফ (কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এর তত্ত্বাবধানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলতো। সেখানে তাদের সঙ্গে কেএনএফ এর প্রধান নাথান বম ও অন্যান্য কুকি-চীন নেতার সঙ্গে সাক্ষাত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে সংগঠনটির নামকরণ করা হয় এবং শুরা কমিটি গঠন করে। মহিবুল্লাহকে সংগঠনটির নায়েবে আমির হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।

সিটিটিসি প্রধানের দাবি, মহিবুল্লাহ ক্যাম্পে অবস্থানের সময় সন্ধ্যার পর প্রশিক্ষণরত সদস্যদের বয়ান দিতেন। তার বয়ানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে জঙ্গি সদস্যদের জিহাদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা।

আসাদুজ্জামান বলেন, শায়েখ মহিবুল্লাহ পাহাড়ে কিছুদিন অবস্থান করার পর ঢাকায় চলে আসেন এবং শুরা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে এনক্রিপ্টেড চ্যাটের মাধ্যমে সমন্বয় করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রম সম্প্রসারণে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।

শুরা সদস্য ডা. শাকেরকে দাওয়াতী কার্যক্রমের বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য শায়েখ মহিববুল্লাহকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সংগঠনের শুরা পর্যায়ের একাধিক সদস্যের সঙ্গে ঢাকা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একাধিক বৈঠকে অংশ নেন। এছাড়া তিনি হাটহাজারীসহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময়ে আসা-যাওয়া করতেন এবং সেখান থেকে পেনড্রাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন জিহাদি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তার ল্যাপটপে সংরক্ষণ করতেন।

জিহাদ সংক্রান্ত বিষয়ে তার নিজস্ব লেখার খসড়া কপিও তার কাছে পাওয়া গেছে। ডা. শাকের সিটিটিসির হাতে গ্রেফতারের পরে শায়েখ মহিবুল্লাহ নিজেকে আড়াল করতে তার ব্যবহৃত সিম ও মোবাইল ফোন নষ্ট করে ফেলেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শায়েখ মহিবুল্লাহ জানান, তিনি উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র নায়েবে আমির হিসেবে কথিত শুরা বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তিনি ভোলার শায়েখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সার্বিক দায়িত্বে ছিল শামীম মাহফুজ।

শায়েখ মহিবুল্লাহ চট্টগ্রামের হাটহাজারির আল জামেয়াতুল আহেলিয়া দারুল উলুম মইনূল ইসলাম মাদ্রাসার ছাত্র থাকার সময়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তৎকালীন হুজির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায় কথিত জিহাদি ট্রেনিং গ্রহণ করেন।

তৎকালীন হুজি নেতা মুফতি আব্দুর রউফ আফগানিস্তানসহ অন্যান্য জায়গায় জিহাদে যাওয়ার ব্যাপারে হাটহাজারি মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় নিয়মিত বক্তব্য দিতেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র জিহাদের ডাক দিতেন। সে সময় হুজির অন্য জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে শায়েখ মহিবুল্লাহ যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।

প্রশাসনের নজরদারির কারণে হুজি-বি’র কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ায় মহিবুল্লাহসহ তৎকালীন হুজির সদস্যরা নতুন একটি প্লাটফর্মে জিহাদী কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করেন। সেই লক্ষ্যে হুজির আরেক নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি তার সঙ্গে ২০১৭ সালে ভোলায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় হুজির অন্য নেতারাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর থেকেই মাইনুল ইসলাম রক্সি ও মহিবুল্লাহ’র মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেফতারে পর হুজির আরেকজন সদস্য রাকিবের সঙ্গে মহিবুল্লাহ’র যোগাযোগ তৈরি হয়। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার কাজে সদস্য সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকেন মহিবুল্লাহ।

এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি শামীম মাহফুজ। তার নির্দেশে একটি কমিটি হয়। কমিটির প্রথম আমির ছিলেন রক্সি। রক্সি গ্রেফতারের পর আরেকজন আমির নিযুক্ত হন। শূরা কমিটির ছয়জন সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে আনিসুল ইসলাম তমালকে নতুন আমির নিযুক্ত ও শায়েখ মহিবুল্লাহকে নায়েবে আমির নিযুক্ত করা হয়।

মূল ব্যক্তি শামীম মাহফুজকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শামীম, তমাল ও রাকিব পলাতক। তাদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, রক্সিকে গ্রেফতারের সময় দায়ের করা মামলায় এজহার নামীয় আসামি ছিলেন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার রনবীর। তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার মাধ্যমে পলাতক শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।

শামীম মাহফুজ সম্পর্কে সিটিটিসি প্রধান বলেন, সে ডিবি পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতার হয়েছিল। শামীম মাহফুজ কুকি-চীন প্রধান নাথাম বমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাহাড়ি অঞ্চলে যাতায়াত ছিল শামীমের। নাথাম বমের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন শামীম। তিনি সপরিবারে নিখোঁজ। তার স্ত্রী এই সংগঠনের জড়িয়েছেন কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গ্রেফতার শায়েখ মহিবুল্লাহকে ডেমরা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ