প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা আগামী ৪১’ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাবো।”
আজ সোমবার সকালে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। আমরা এখানেই থেমে থাকিনি, ২১০০ সালের ব-দ্বীপ কেমন হবে- সে পরিকল্পনাও নিয়েছি।
স্মার্ট বাংলাদেশে প্রযুক্তির মাধ্যমে সবকিছু হবে। সেখানে নাগরিকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে এবং এর মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতি পরিচালিত হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার এবং সমাজকে স্মার্ট করে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যেই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে।
বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে তরুণ প্রজন্মকে সৈনিক হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০৪১ সালের সৈনিক হিসেবে তোমাদের (তরুণদের) স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে হবে।
অনুষ্ঠানে ‘অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতা ২০২২’ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার’ বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক, জয় সিলিকন টাওয়ার, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল জাদুঘর ও একটি সিনেপ্লেক্স এবং বরিশাল জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার উদ্বোধন করেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ কামাল ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক দুটি বইয়ের ডিজিটাল ও প্রিন্ট সংস্করণের মোড়কও উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এমপি।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২-এর থিম সং, ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে একটি অডিও ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টারি অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন ২০২১’ এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন।
তাঁর ওপর বার বার হামলা এবং ভয়-ভীতির তোয়াক্কা না করে দেশের উন্নয়নের একের পর এক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান এবং ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন করে দিয়ে গেলাম। অর্থাৎ ২১ থেকে ৪১ কিভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে তার একটা কাঠামো,পরিকল্পনা আমরা প্রণয়ন করে বাংলাদেশের জনগনের জন্য আমি রেখে যাচ্ছি। এই ব-দ্বীপ প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়, দেশ উন্নত হয় এবং উন্নত দেশে স্বাধীনভাবে সুন্দরভাবে যেন তারা স্মার্টলি বাঁচতে পারে। সেই ব্যবস্থাও করে দিয়ে গেলাম।
তিনি বলেন, এখন সব নির্ভর করছে আমাদের ইয়াং জেনারেশন ও যুব সমাজের উপর। ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের উন্নতি’। এটাই ছিল আমাদের ২০১৮ এর নির্বাচনী ইশতেহার। আমরা সেই কাজই করে যাচ্ছি। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপনকালেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি, ই-গভর্নমেন্ট এবং ইন্ডাষ্ট্রি প্রোমোশন ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে ২০০৮ সালে নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী তাঁর সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে। সারাদেশে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি দিয়েছে এবং স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপন করেছে।
বাংলাদেশের এই রূপান্তরের নেপথ্য কারিগর হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পুত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমার ছেলে জয় যদি আমাকে পরামর্শ না দিতো তাহলে হয়তো আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব হতোনা।”
১৯৯২ সালে বিএনপি’র আমলে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইন- সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপে সংযোগ দিতে চাইলে ‘তথ্য পাচার’ হয়ে যাবার অযুহাতে তা খালেদা জিয়ার সরকার প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে ২১ বছর পর সরকারে এসে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের ১০ হাজার স্কুলের জন্য অর্ধেক দামে নেদারল্যান্ড থেকে কম্পিউটার আমদানীর চুক্তি করলে কেবল শেখ রেহানার কন্যা, বর্তমান ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিকির নামে সে কোম্পানীর নাম ‘টিউলিপ’ হওয়ায় পরবর্তী বিএনপি সরকার সে চুক্তি বাতিল করলে দেশতো কম্পিউটার পায়নি উপরন্তু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ৩২ কোটি টাকা জরিমানা দিয়ে নিস্কৃতি পায় বলেও তাদের অজ্ঞানতার উদাহারন তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা সরকারে এসে এই খাতের উন্নয়নে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করি। সফ্টওয়্যার, ডাটা-এন্ট্রি, ডাটা-প্রসেসিং-এর উন্নয়নে আইটি-ভিলেজ এবং হাইটেক-পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিই। শুল্কমুক্তভাবে কম্পিউটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং সফ্টওয়্যার আমদানির অনুমোদন দেই।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে কানেকটিভিটি রয়েছে বলে করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যেও কোন কাজ থেমে থাকেনি বলেও জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে এমনকি দ্বীপ-পাহাড়-হাওড়-চরাঞ্চলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ নিশ্চিত করেছি। করোনার সময় ঘরে বসেও অনেকে কাজ করে পয়সা উপার্জনের সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে মাট ৮ হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টার চালু আছে। যেখানে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা হবার সুযোগ পেয়েছে। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট সমৃদ্ধ জাতীয় তথ্য বাতায়ন তৈরি করেছি। আমাদের ‘মাই-গভ’ মডেল এখন ফিলিপাইনে এবং ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ফর স্কিলস্, এডুকেশন, এম্পøয়মেন্ট, এ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনিওরশীপ’ সোমালিয়ায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন অনেক দেশই বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে এবং বাংলাদেশের কাছ থেকে সহযোগিতাও নিচ্ছে। আমরা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর পাশাপাশি করোনাকালিন ভার্চুয়াল কোর্টও চালু করেছি।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার ৫শ’টি ‘জয় ডি-সেট ল্যাব’, ১৩ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন করেছে। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য লার্নিং এন্ড আর্নিং অ্যাপ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের স্বীকৃতিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের কল-সেন্টার ভিত্তিক সেবা, যেমন, জরুরি সেবা প্রাপ্তিতে ৯৯৯, যেকোন তথ্য জানার জন্য ৩৩৩, কৃষকবন্ধু সেবা প্রাপ্তিতে ৩৩৩১-সহ টেলিমেডিসিন সেবা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যখন বিদেশে যান তখনও তাঁর ফাইল দেখা বন্ধ হয়না। কেননা তাঁর সরকার ২০১৯ সালে ‘ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে প্রদান করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
ইন্টারনেটকে আরো সহজলভ্য করতে ব্যান্ডউইথের দাম কমানো এবং মোবাইল ফোনকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেয়ায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৮ কোটি মোব্ইাল সীম ব্যবহার হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তাঁর সরকার ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের উপবৃত্তি মায়েদের মোবাইলফোনে চলে যায়। এই বৃত্তি দেয়া যখন শুরু হয় তখন ২০ লাখ মায়ের মোবাইল ফোন ছিল না। তাদের মোবাইলফোন কিনে দিয়ে আমরা সেটা চালু করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছি। এজন্য পৃথক ফান্ডও বাজেটে রয়েছে। পাশাপাশি আইডিয়া প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিগ), ‘শতবর্ষের শত আশা’ এবং ‘স্টার্টআপ সার্কেল’ সৃষ্টি করে অনুদান দিচ্ছি। বিনিয়োগের জন্য ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে সরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা এবং শেয়ারবাজারে পৃথক এসএমই বোর্ড চালু করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ভেঞ্চার তহবিল পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ হাজার ৫০০-এর বেশি স্টার্টআপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে অবস্থান করছে।
করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার ফলে দেয়া নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া, উন্নত দেশগুলোর হিমশিম খাওয়া এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশেরও নিজেদেরকে অর্থনৈতিক মন্দার দেশ হিসেবে ঘোষণার কথা তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখনো আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।’
তিনি বলেন, কিছুদিন আমাদের একটু অসুবিধা হয়েছে। তারপরতো আমরা করে যাচ্ছি। কাউকে বঞ্চিত করিনি। অর্থাৎ আমাদের সেই সক্ষমতাটা এসেছে।