বৃহস্পতিবার, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংসদ নির্বাচনে সংলাপে জোর পর্যবেক্ষকদলের

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষকদল। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় পরীক্ষা বলেও মন্তব্য করেছে দলটি।

শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে পর্যবেক্ষকদলটি বাংলাদেশ সফর নিয়ে তাদের মূল্যায়ন প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া এই দল গত ৮ থেকে ১১ অক্টোবর ঢাকা সফর করে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে পর্যবেক্ষকদলটি গঠিত হলেও এর অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এই সফরের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল। সেই বিচারে দলটির পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো গুরুত্ব বহন করে।

প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষকদলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বর্তমান ও সাবেক নারী সংসদ সদস্য, যুবসমাজ, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলমান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।

প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে এমন বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অহিংস নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রূপরেখা হিসেবে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তারা মূলত নির্বাচন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে। ভিন্নমতকে সম্মান করাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং নাগরিকদের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত রাখার সুপারিশ করেছে তারা।

এ ছাড়া সহিংসতা না করার অঙ্গীকার এবং সহিংসতা যারা করবে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার তাদের সুপারিশে স্থান পেয়েছে।

সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য জোরালো পরিবেশ সৃষ্টিরও সুপারিশ করেছে দলটি। নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি সক্রিয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপরও তারা জোর দিয়েছে।

প্রতিনিধিদলের অন্যতম নেতা ছিলেন আইআরআইয়ের কো-চেয়ার ও ইউএসএআইডির সাবেক উপপ্রশাসক বনি গ্লিক। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অহিংস নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের বিষয়ে যাঁরা মতামত দিয়েছেন তিনি তাঁদের প্রশংসা করেছেন। সফর শেষে তাঁদের সুপারিশগুলো বাংলাদেশে নির্বাচনপ্রক্রিয়া উন্নত করতে সহযোগিতা করবে বলে তিনি আশা করেন।

প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্য এনডিআই কো-চেয়ার ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কার্ল ইন্ডারফুর্থ বলেন, ‘প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গঠনমূলক সম্পৃক্ততা না থাকাই মূল সমস্যা বলে আমরা মনে করি। আগামী জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে এবং নির্বাচনের পর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই এই অচলাবস্থা দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায়।’

আস্থার ঘাটতি

পর্যবেক্ষকদলের পর্যবেক্ষণে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক যাত্রায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ স্থান পেয়েছে। আপসহীন রাজনীতি, উসকানিমূলক বক্তব্য, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা, ভয়ের পরিবেশ, নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও কাজের সুযোগ কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক নেতা ও অন্য অংশীদারদের মধ্যে আস্থার ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছে পর্যবেক্ষকদল। তাদের মতে, এই চ্যালেঞ্জগুলো গণতান্ত্রিক নীতির জন্য হুমকি। এটি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের ইতিবাচক ধারাকে দুর্বল করতে পারে।

সামনে কঠিন পরীক্ষা

আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে তারা বলেছে, বাংলাদেশ ক্রান্তিলগ্নে রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার পালনের দিক থেকে এক কঠিন পরীক্ষা।

দলটি আশা করছে, বাংলাদেশের জনগণই চূড়ান্তভাবে তাদের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতা এবং দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে।

বাড়তে পারে উত্তেজনা, সংঘাত

পর্যবেক্ষকদল বলেছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন, সহিংসতা, ধর্মঘট ও নির্বাচনী অনিয়ম অনেক বাংলাদেশির কাছে নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করেছিল। ফলে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এখন নিয়মিতভাবে কম।

দলটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরকারের সমালোচকরা ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। বিএনপির নাম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নির্বাচনে প্রশাসন দায়িত্ব না নিলে দেশের প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের পরিকল্পনা করছে। আর সরকার তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এর ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থা বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক পছন্দ প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করছে। ব্যাপক অবিশ্বাসের পরিবেশ, রাজনৈতিক সংলাপের অনুপস্থিতি উত্তেজনা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে সহিংসতা বাড়াতে পারে।

নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাঁরাই সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোট ও গণনা প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা প্রদান করেন।

পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আইনগতভাবে মন্ত্রণালয়ের নির্বাচনী কর্মী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু তাঁরা শুনতে পেয়েছেন, নির্বাচনের দিন স্বাধীনভাবে সমস্যা চিহ্নিত করার বা ভোটকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশনা কার্যকর করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। এটি ভোটদান ও গণনার ওপর অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ থাকার বহিঃপ্রকাশ। এটি সামগ্রিক প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমায়। এ কারণে কমিশনের প্রতি নাগরিক সমাজ ও বিএনপির আস্থার ঘাটতি আছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা

পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারে আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা স্বার্থের দ্বন্দ্বের সুযোগ কমায়। কার্যকর প্রচারাভিযানে খরচ করা অর্থ তদারকির জন্য একটি শক্তিশালী আইনি আদেশ, পর্যাপ্ত নজরদারি এবং একটি বাধ্যতামূলক প্রয়োগকারী ব্যবস্থার প্রয়োজন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রচারণায় অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়ম মোকাবেলার জন্য কোনো আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।

নির্বাচনী অভিযোগ এবং বিরোধ নিষ্পত্তি

পর্যবেক্ষকদল বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে উচ্চ মাত্রার মেরুকরণ এবং প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি করার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো আশা করবে, আদালত নিরপেক্ষভাবে যেকোনো নির্বাচনী বিরোধের সমাধান করবে এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে রাজনৈতিক চাপ প্রতিহত করবে।

পর্যবেক্ষকদের জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত নিয়ম আন্তর্জাতিক রীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

প্রার্থী মনোনয়নে স্বচ্ছতার অভাব

পর্যবেক্ষকদলটির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশিদের অনেকে বলেছেন, দলগুলোর মধ্যে মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় প্রায়ই স্বচ্ছতা এবং প্রতিযোগিতার অভাব থাকে। সাধারণত সম্পদশালী, রাজনৈতিক বা পারিবারিক সম্পৃক্ততা আছে এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। এটি নারী, তরুণ এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। বিদ্যমান মনোনয়নপ্রক্রিয়া তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতিশীল এবং বৈচিত্র্যময় নতুন প্রার্থীদের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগের অভাব

প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণা ও কর্মসূচিতে সমান সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগের কথা তুলে ধরা হয়। বিএনপির কর্মসূচির দিন পরিবহন ধর্মঘটের মতো বিভিন্ন বাধার উদাহরণ তুলে ধরেছেন তাঁরা।

নির্বাচনী সহিংসতা ও নিরাপত্তা

মার্কিন প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতা ঘটাতে তাদের যুব ও ছাত্র শাখাকে ব্যবহার করে। আগামী সংসদ নির্বাচনে নারীদের নিরাপদ ও অর্থবহ অংশগ্রহণের জন্য এটি একটি বাধা হয়ে থাকতে পারে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতায় সাম্প্রতিক পরিবর্তন নিয়ে অংশীদাররা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গণমাধ্যমে স্বতঃপ্রণোদিত বাধা

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু গণমাধ্যমের ব্যাবসায়িক স্বার্থ প্রায়ই সরকারের সমালোচনাকে বাধা দেয়। সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো নিজে থেকেই সরকারের অনেক সমালোচনা এড়িয়ে চলে।

এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনও সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষকদলের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিদেশিদের কাছে যাই না, তারা আমাদের কাছে আসে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থায় পর্যবেক্ষকদলের কোনো ভূমিকা নেই। তার পরও দেশটির লোক এসে বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের কথা বলে। এটা দুঃখজনক।

মন্ত্রী বলেন, দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রথা নেই। কিন্তু সে দেশগুলো ভালো চলছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ