ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা বলেছেন, বর্তমান সরকার অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার কথা বলছে। অথচ ৫৩ বছরের প্রথা ভেঙে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে; এটা সরকারের অবস্থানের বিপরীত। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গভর্নর কার স্বার্থ রক্ষা করছেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
সোমবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করেন সংগঠনের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
ইআরএফের নেতারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিয়ে ডেপুটি গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি।
গত ২১ মার্চ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অলিখিতভাবে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান চেয়ে ইআরএফের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়েছে এবং দুই দফা চিঠি দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে এই সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হলেও সমস্যার সমাধান না করে এখন বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
ইআরএফ সভাপতি বলেন, ‘একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। সাংবাদিকেরা আগে নিজের কার্ড প্রদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারতেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাময়িক পাস দেওয়া হতো; এখন তা বন্ধ করা হয়েছে। হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় নানা গুজব ডালপালা মেলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।’
ইআরএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের আগের মতো অস্থায়ী পাস নিয়ে নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দিতে হবে। যদি নিয়মতান্ত্রিক আলোচনায় প্রবেশাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায় করা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকেরা প্রবেশ করতে পারে কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন-এমন প্রসঙ্গ তুলে ইআরএফ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের জানতে হবে, অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইট অনেক সমৃদ্ধ। সেখানে অর্থনীতির সব সূচকের নিয়মিত হালনাগাদ ছাড়াও পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী, বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ সব ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হয়; কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করলে দ্রুত তার জবাব দেওয়া হয়। আবার এসব দেশের আর্থিক খাতের সুশাসনের মাত্রা অনেক উঁচুতে। পদ্ধতিগত কারণে সেখানে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য আড়াল করা কঠিন। এ ছাড়া বেনামি ঋণ, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী বা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কেউ কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারে বলে আমাদের জানা নেই। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত রেখে কেবল সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মাধ্যমে কি তথ্য আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে, আমরা সে প্রশ্ন রাখতে চাই।’
দাবি না মানা হলে কী কর্মসূচি দেওয়া হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম জানান, আগামী জাতীয় বাজেটের আগে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে বাজেটের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে অবস্থান ও সমাবেশ করা হবে। দাবি না মানা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও মুখপাত্রের সব ধরনের অনুষ্ঠান বর্জন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মিথ্যাচার-প্রোপাগান্ডামূলক বক্তব্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন হারানোর কারণে আর্থিক খাতের দুরবস্থার কথা বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকের বক্তব্যে উঠে এসেছে বলে উল্লেখ করেন ইআরএফ সভাপতি। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, তদারকি ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে নীতির ধারাবাহিকতা রাখতে না পারার বিষয়টি সবার জানা।
একইভাবে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে তড়িঘড়িজনিত অস্থিরতা এবং ব্যাংক খাতের বর্তমান তারল্য–সংকটের বিষয়টি সবার জানা। এসব সমস্যার সমাধান না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে; এতে জনমনে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। তথ্যপ্রবাহ আটকানোর চেষ্টা দেশের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে; এটাও কারও কাম্য নয়।
সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে আগের মতো আর্থিক খাতের প্রকৃত তথ্য সবাইকে জানার সুযোগ দেওয়ার জোর দাবি জানায় ইআরএফ।