শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পারমাণবিক যুদ্ধের রুশ হুমকি কতটা উদ্বেগজনক?

রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করার পর থেকেই মস্কোর দিক থেকে জোর গলায় এবং নিয়মিত শোনা গেছে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি।

উর্ধতন রুশ কর্মকর্তারা রাখঢাক না করেই আভাস দিয়েছেন যে পশ্চিমা দেশগুলো – যারা ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে – তারা যেন রাশিয়াকে খুব বেশি কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে।

কয়েকদিন আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেলারুসে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করার পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছেন।

পুতিনের ঘনিষ্ঠতম সহযোগীদের একজন নিকোলাই পাট্রুশেভ সতর্ক করে দিয়েছেন যে রাশিয়ার হাতে এমন “আধুনিক ও অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অস্ত্র আছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যে কোন শত্রুকে ধ্বংস করে দিতে পারে।“

শুধুই কি কাগুজে হুমকি?
প্রশ্ন হলো, এসব কি শুধুই ভয় দেখানোর জন্য কথার কথা, বা ধাপ্পা ? নাকি এগুলো এমন হুমকি – যা গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার?

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাটভ হচ্ছেন এমন একজন রুশ সাংবাদিক রাশিয়ার ভেতরে এ নিয়ে কি বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে তার ওপর নজর রাখছেন।

তিনি যা দেখছেন তাতে তিনি উদ্বেগ বোধ করছেন, জানাচ্ছেন বিবিসির রাশিয়া বিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ।

রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ মুরাটভের পত্রিকা ‘নোভায়া গেজেটা’ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে তিনি দমবার পাত্র নন।

তিনি বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এই সংঘাতে রাশিয়া আসলে কতদূর যেতে পারে – তা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন।

মস্কোয় বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ কথা বলেছেন মি. মুরাটভের সাথে।

“পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা ছাড়াই এর মধ্যে দুটি প্রজন্ম তাদের জীবন পার করেছে” – বলছিলেন মুরাটভ – “কিন্তু সে যুগ শেষ। পুতিন কি তার ‘পারমাণবিক বোতামে’ চাপ দেবেন? নাকি দেবেন না? কেউ জানে না। এমন একটি লোকও নেই যে নিশ্চিতভাবে এর জবাব দিতে পারে।“

তিনি বলছেন, রাশিয়ার ভেতরে তিনি উদ্বেগজনক কিছু লক্ষণ দেখছেন।

পারমাণবিক যুদ্ধর জন্য প্রস্তুতি?

“আমরা দেখছি, কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় মানুষকে এমনভাবে ভাবতে তৈরি করে তোলা হচ্ছে যে পারমাণবিক যুদ্ধ আসলে খারাপ কিছু নয়” – বলছেন মুরাটভ, “এখানকার টিভি চ্যানেলগুলোতে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং পারমাণবিক অস্ত্রকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন এগুলো পোষা প্রাণীর খাবার বিজ্ঞাপন।“

“তারা ঘোষণা করছে যে ‘আমাদের অমুক মিসাইল আছে, তমুক মিসাইল আছে’ – তারা বলছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর কথা , বলা হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সাগরে এমন সুনামি সৃষ্টি করা হবে যাতে আমেরিকা ভেসে যাবে।“

“কেন তারা এসব বলছে, যাতে লোকে এ জন্য প্রস্তুত হয়।“

কিছুদিন আগে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভিতে একটি টক-শোর উপস্থাপক বলেন, রাশিয়ার উচিত ফ্রান্স, পোল্যাণ্ড এবং যুক্তরাজ্যের ভূখন্ডে থাকা যে কোন সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে (রাশিয়ার) ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঘোষণা করা।

এই একই উপস্থাপক এক পর্যায়ে আরো পরামর্শ দেন, “কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে একটি দ্বীপকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার, বা একটি ট্যাকটিকাল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণা করার” – যাতে কারো মনে এ নিয়ে কোন বিভ্রম না থাকে।

রাষ্ট্রীয় প্রচারণা
এর পরও রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় রাশিয়াকে তুলে ধরা হচ্ছে একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে, এবং ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বকে আক্রমণকারী হিসেবে। অনেক রুশ তা বিশ্বাসও করেন।

মি. মুরাটভ বলছেন, এসব প্রপাগান্ডা কাজ করছে তেজষ্ক্রিয়তা ছড়ানোর মত করে।

“এতে প্রভাবিত হচ্ছে সবাই, শুধু রাশিয়ানরা নয়। রাশিয়ার ১২টি টিভি চ্যানেল, হাজার হাজার সংবাদপত্র, ভিকে-র মত সামাজিক মাধ্যম (ফেসবুকের রুশ সংস্করণ) – এরা সবাই রাষ্ট্রীয় আদর্শিক লাইন অনুসরণ করে।“

কিন্তু কোন কারণে হঠাৎ এই প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে?

মুরাটভ বলেন, রাশিয়ার তরুণ প্রজন্ম খুবই চমৎকার, তারা শিক্ষিত – এবং প্রায় আড়াই লক্ষ রুশ দেশ ছেড়ে চলে গেলেও যারা রয়ে গেছে তারা ইউক্রেনে যা হচ্ছে তার বিরোধী।

“আমি নিশ্চিত যে এই প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেলেই এ প্রজন্ম এবং অন্য যাদের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি আছে – তারা মুখ খুলবে।“

মি. মুরাটভ বলছেন, তাদের অনেকে ইতোমধ্যেই এটা করছে।

“যেসব রুশ প্রতিবাদ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ২১ হাজার মামলা করা হয়েছে। বিরোধী দল এখন কারারুদ্ধ। অনেক মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেক অধিকারকর্মী, বেসামরিক লোক ও সাংবাদিককে বিদেশী এজেন্ট বলে অভিহিত করা হয়েছে” – বলেন তিনি।

পুতিনের পক্ষে সমর্থন কতটা?
দিমিত্রি মুরাটভ বলছেন, এটা ঠিক যে পুতিনের পক্ষে এখনো বিশাল জনসমর্থন আছে। তবে তারা মূলত বয়স্ক জনগোষ্ঠী যারা পুতিনকে তাদের ‘নাতি’ বলে মনে করে – যিনি তাদের সুরক্ষা দেবেন, প্রতি মাসে পেনশন দেবেন এবং প্রতিবছর ‘শুভ নববর্ষ’ জানাবেন।

“এই লোকেরা বিশ্বাস করেন যে তাদের আসল নাতিদের উচিত যুদ্ধ করতে যাওয়া, জীবন দেয়া।”

গত বছর মি. মুরাটভ ইউক্রেনের শিশু শরণার্থীদের জন্য অর্থ তুলতে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার নিলামে বিক্রি করে দিয়েছেন।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আর তেমন আশাবাদী নন।

তিনি মনে করেন ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না, এবং রাশিয়ার ভেতরে সরকারবিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে।

দিমিত্রি মুরাটভ শুধু তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই কিছু আশা দেখতে পান – যারা বিশ্বকে শত্রু নয়, বরং বন্ধু হিসেবে দেখে। “যারা চায় যে বিশ্ব রাশিয়াকে এবং রাশিয়া বিশ্বকে ভালোবাসুক”

“আমি আশা করি যে এ প্রজন্ম আমার আর পুতিনের চেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকবে” – বলেন তিনি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ