বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে নারীর উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চিতে গত তিন দশকে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে-এ কথা অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ-সব ক্ষেত্রেই নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি আজ একটি নতুন সামাজিক বাস্তবতা। ১৯৯০-এর পর থেকে ২০২৫ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ পর্যায়গুলোতে নারী নেতৃত্বের দৃশ্যমান ভূমিকা এই পরিবর্তনকে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করেছে। অথচ একই সমাজে বেগম রোকেয়ার মতো নারী জাগরণের পথিকৃৎকে “কাফির” বা “মুরতাদ” আখ্যা দেওয়ার মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতা এখনো উচ্চশিক্ষার শিক্ষকসমাজের ভেতরও প্রকাশ পায়-এ এক ভয়াবহ সামাজিক বৈপরীত্য। এই দুই বাস্তবতার সংঘাতই আজকের বাংলাদেশের নারী অধিকার, নাগরিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক আচরণকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপকের মন্তব্য কেবল অশালীন নয়; এটি বাংলাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের ওপর সরাসরি আঘাত। বেগম রোকেয়া যে সময় বেঁচে ছিলেন, তখন নারীশিক্ষা ছিল নিষিদ্ধপ্রায়। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং সামন্তীয় দৃষ্টিভঙ্গি নারীর স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে রেখেছিল। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েই রোকেয়া তাঁর শিক্ষা আন্দোলন, ‘সুলতানার স্বপ্ন’–এর মতো প্রগতিশীল সাহিত্য এবং প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কবরস্থান পর্যন্ত তাকে না দেওয়ার ঘটনাটি দেখায়—কুসংস্কারের শিকড় কত গভীরে প্রোথিত ছিল। বিস্ময়কর হলো, শত বছর পরও সেই মানসিকতার প্রতিধ্বনি আজও উচ্চশিক্ষার অভয়ারণ্যে প্রতিভাত হয়। এটি প্রমাণ করে আমাদের সমাজ এখনো সামগ্রিকভাবে আধুনিক মূল্যবোধে রূপান্তরিত হতে পারেনি; নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অনেকখানি দুর্বল।
অন্যদিকে, একই দিনে দেশের আরেক প্রান্তে ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের একটি রাজনৈতিক আচরণ—তারেক রহমানের প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা। ২০ বছর আগের একটি ঘটনার জন্য একজন সামরিক কর্মকর্তার কাছে এমন সম্মানজনক, ভদ্রোচিত ক্ষমা প্রার্থনা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল। ক্ষমা প্রার্থনা স্বীকারোক্তি নয়; বরং পরিপক্বতা, দায়িত্ববোধ এবং অহং পরিহারের পরিচায়ক। দীর্ঘদিনের সংঘর্ষময় রাজনৈতিক পরিবেশে এমন আচরণ নেতৃত্বের নতুন ধারার ইঙ্গিত দেয়—যেখানে প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়, মানুষ হিসেবে স্বীকার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ক্ষমা-সংস্কৃতি একটি সমাজকে শান্তি, সমঝোতা ও পরিণত গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আচরণ যদি নিয়মে পরিণত হয়, তাহলে প্রজন্মভিত্তিক বিভাজন, ঘৃণা–রাজনীতি ও সহিংস দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে আসবে।
এই দুই ঘটনার তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তোলে: নারীকে অবমাননা করা একজন শিক্ষকের উগ্রতা এবং জাতীয় নেতার ভদ্রতা—এ দুই বিপরীত মানসিকতা একই সমাজে একসাথে টিকে থাকে কীভাবে? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের অসম ও অসমাপ্ত চরিত্রে। সামাজিক পরিবর্তন যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে দ্রুত আসে, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সে তুলনায় অনেক ধীরগতি সম্পন্ন। নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি, ভিন্নমতকে সম্মান, যুক্তি-আলোচনায় বিশ্বাস—এসব মূল্যবোধ ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মনস্তত্ত্বে ধীরে জন্ম নেয়। তাই রাষ্ট্রে নারী নেতৃত্ব থাকলেও সমাজের রক্ষণশীল অংশ দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তিত হয়নি; বরং রাজনৈতিক-ধর্মীয় উগ্রবাদ তাদেরকে নতুন খোলসে পুরনো মানসিকতা প্রচারের সুযোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রগতির কেন্দ্রেও সেই মানসিকতা জন্ম দেয় সংকীর্ণতা, ঘৃণা ও নারীবিদ্বেষের চরম রূপ।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সামাজিক যাত্রাপথ তাই নির্ভর করবে কোন মানসিকতা সামনে এগিয়ে যায়—উগ্র ঘৃণা, নাকি পরিশীলিত আলোচনার সংস্কৃতি। ক্ষমা–সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্মান ও যুক্তিনির্ভর আলোচনার ধারাটি যদি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে শক্তিশালী হয়, তাহলে ব্যক্তি–সমাজ–রাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও মানবিক হবে। নারীর অগ্রগতি শুধুমাত্র আইন বা নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তে নয়; বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনেই স্থায়িত্ব পায়। তাই শিক্ষকের কটূক্তি কেবল একজন নারী নেত্রীকে অপমান নয়, এটি সমগ্র জাতির মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জ। আর তারেক রহমানের আচরণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে—যদি তা বৃহত্তর সমাজে অনুকরণীয় হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ আজ সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে অগ্রগতির আলো ও অতীতের অন্ধকার—দুটি শক্তি সমান্তরালে চলমান। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া আমাদের শিখিয়েছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে জ্ঞানের সাহস। আর তারেক রহমানের ভদ্রতা, অনুশোচনা ও দায়িত্ববোধ আমাদের শিখিয়েছে সভ্য সমাজ গঠন কীভাবে সম্ভব। এই দুই শিক্ষাই আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশ। প্রশ্ন শুধু একটি-আমরা কোন পথ বেছে নেব?
মো: হাফিজ আল-আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।








