মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জুলিও কুরি পদক:বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান

২৩ মে,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তি দিবস।১৯৭৩ সালের এই দিনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে পদক তুলে দেন।এই বছরটি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০ টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিন্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।এবং পরবর্তী বছরের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র ‘জুলিও কুরি’ পদক বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন।

পদক প্রদান কালে মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেন,‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন,আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’

জুলিও কুরি পদক গ্রহণকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,‘এই সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়।এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মদানকারী শহীদদের,স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানিদের,জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের।’

জুলিও কুরি পদক হচ্ছে বিশ্ব শান্তি জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক পদক।নোবেল বিজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী দম্পতি জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ও ইরেন জুলিও কুরির নামে বিশ্ব শান্তি পরিষদ এ পুরস্কার প্রদান করে।১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী,সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে,মানবতার কল্যাণে,শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বের বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে জুলিও কুরি শান্তি পদক দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুকে যখন জুলিও কুরি পদক প্রদান করা হয় তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে নি।হাতে গোনা কয়েকটি দেশ মাত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।এমন একটি সময়ে এই আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মাননা মোটেও সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর।তারঁ ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের কারণে এই স্বল্পতম সময়ে তিনি ১২৭ টি দেশ সহ জাতিসংঘ,আইএমএফ,কমনওয়েলথ,ওআইসির মতো শীর্ষ দশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হন।

বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনই শান্তির জন্য কাজ করেছেন।ছাত্রাবস্থায় কলকাতা পড়াকালীন সময়ে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে রক্ষা করেছিলেন।পাকিস্তান সৃষ্টির পরও যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনই বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়িয়েছেন।বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।বিভিন্ন দেশের মানুষের কথা শুনেছেন,নিজ দেশের অভিজ্ঞতা অন্য দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেছেন।১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ যোগ দিয়ে ৩৭ টি দেশ থেকে আগত নেতাদের কাছ থেকে বিশ্ব শান্তির আলোচনা শুনেছেন।

এছাড়াও ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’-এর সম্মেলনেও যোগদান করে বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি।নিপীড়িত,নির্যাতিত,শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ,যেকোনো স্থানেই হোক না কেন,তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি।আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক,তাকে সুসংহত করা হোক।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জেল-জুলুম,অত্যাচার,নির্যাতন সহ্য করে শান্তি,সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন।বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়েছেন।আর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা থেকে হয়ে উঠেন বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’।আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলিও কুরি পদকের পর আন্তর্জাতিক ভাবে হয়ে উঠেন বিশ্ব বন্ধু।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং ‘সকলের সাথে বন্ধত্ব,কারও প্রতি বৈরতা নয়’ এই নীতিতে পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হিসেব গ্রহণ করেছিলেন।জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির পর বঙ্গবন্ধু শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরো জোরালো প্রতিবাদী হয়ে উঠেন।পৃথিবীর যেখানেই গেছেন সেখানেই বিশ্ব শান্তির কথা বলেছেন।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত,শোষক আর শোষিত।আমি শোষিতের পক্ষে।’১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে জীবনের প্রথম ও শেষ বক্তব্য প্রদানকালেও তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

তিনি বলেন,শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাংখার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।জাতিসংঘ সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।

বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে,মানবতার কল্যাণে,শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদককে ভূষিত করে আসছে।যেসকল বরেণ্য ব্যক্তিরা জুলিও কুরি পদক পেয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা দেখেই যেকেউ এর গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝতে পারবেন।বঙ্গবন্ধুর আগে কিংবা পরে যাঁরা জুলিও কুরি পদক পেয়েছেন,তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন -ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু,কিউবা বিপ্লবের প্রধান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো,ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হো চি মিন,ফিলিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা ইয়াসির আরাফাত,চিলির প্রথম সমাজতন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী সালভেদর আলেন্দে,দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা,ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী,নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মাদার তেরেসা,চিলির কবি,কুটনৈতিক ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা,

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা মার্টিন লুথার কিং,সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয়তাবাদী নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ,ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল,তুরস্কের মহান ও বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত,ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিন প্রমুখ।তালিকা দেখেই বুঝা যায় সেসময়ে ‘জুলিও কুরি’ পদক নোবেল শান্তি পুরস্কার থেকেও বেশি মর্যাদাবান ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের শোষিত,বঞ্চিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ তেইশ বছর লড়াই সংগ্রাম করেছেন।দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনায় সকলের মাঝে শান্তি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে।

সাম্য-মৈত্রী,গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক দেয়া হয়।এটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের নিরলস প্রচেষ্টা,কর্ম ও দর্শনের স্বীকৃতি।এটি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালির নেতাই ছিলেন না,ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত-শোষিত মানুষের নেতা।

‘জুলিও কুরি শেখ মুজিব,লও লও লও সালাম। শান্তির দূত শেখ মুজিব লও লও লও সালাম।’ যারা ছাত্রলীগ করেছেন,তারা এই স্লোগানটি হাজার হাজার বার দিয়েছেন। আমার সুযোগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একজন কর্মী থাকা অবস্থায় হাজারো বার এই স্লোগানটি দেওয়ার।সত্যি কথা বলতে কি,তখন কিন্তু এই স্লোগানটির মর্ম কথা বুঝিনি। যতই দিন যাচ্ছে,ততোই বুঝতে পারছি ‘জুলিও কুরি’ পদকের গুরুত্ব।আজ বঙ্গবন্ধু স্মরণ করে বিনম্র চিত্তে আবারও বার বার বলতে ইচ্ছে করছে, জুলিও কুরি শেখ মুজিব,লও লও লও সালাম।

লেখক:সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল:haldertapas80@gmail.

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ