জামায়াতে ইসলামীর একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত নেতাসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর একটি ক্লাবে মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতার বৈঠকের খবর প্রকাশ্যে আসার পর যুদ্ধাপরাধ বিরোধী, মানবাধিকার কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা উগ্রপন্থি সংগঠনটি সর্বশেষ হুমকির পেছনে মার্কিন দূতাবাসের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে সময় রাজপথে নেমে সরকার পতনে বিএনপির দাবির সঙ্গে জামায়াতও কর্মসূচি দিয়েছে। তাতে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে।
শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে আমেরিকান দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারি ম্যাথিউ বে’র গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠকের সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পর যুদ্ধাপরাধ বিরোধী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মীরা এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এর আগে গণমাধ্যমের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পিটার হাসের মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিল জামায়াত ইসলামীর পরিচালিত একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু। একনায়কতন্ত্র থেকে দেশকে উদ্ধারের চেষ্টা আসলেই প্রশংসনীয়। আশা করি, তিনি (পিটার হাস) বাংলাদেশকে একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তর করার এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।’
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত করতে সহায়তা করেছিল। এ ছাড়া সংগঠনটির বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে যেখানে আগামী কয়েকমাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে, ঠিক এ সময়ে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তার সঙ্গে জামায়াত নেতার বৈঠক নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন। এরইমধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা কর্মসূচিকে ঘিরে রাজপথে উত্তেজনা বেড়েছে। তারা বলছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ড সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কিনা।
জামায়াতে ইসলামী একটি যুদ্ধাপরাধী এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের কর্মসূচি পালনে পুলিশ অনুমতি দেয়নি।
জামায়াত নেতা ও মার্কিন কর্মকর্তার মধ্যে বৈঠকের পর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান পুলিশের অনুমতি না দেয়া সত্ত্বেও শনিবার (২৮ অক্টোবর) মতিঝিলের শাপল চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তার সঙ্গে জামায়াত নেতার বৈঠকের পর দলীয় নেতাকর্মীদের সরকার পতনের জন্য বিএনপি-জামায়াতের পদক্ষেপের পেছনে মার্কিন দূতাবাসের সরাসরি সমর্থনের বিষয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন।
এর আগে গণমাধ্যমের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ নিয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ১৯০ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
বিবৃতিতে লেখক, অধিকারকর্মী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য, যুদ্ধাপরাধবিরোধী প্রচারক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীসহ মোট ১৯০ জন বিশিষ্ট নাগরিক সই করেন।
অন্যদিকে সরকার পতনের জন্য বিএনপি নেতারা পিটার হাসকে ‘অবতার’ বা ‘ত্রাণকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন। যদিও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণারও নিন্দা জানিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। বাংলাদেশে অতীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় দলীয় ক্যাডারদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে না বিএনপি-জামায়াত।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ২৮ হাজার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ এবং নির্বাচন বয়কটের মধ্যে অন্তত ৩২টি জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছেন যুদ্ধাপরাধ বিরোধী এবং মানবাধিকার কর্মীরা। যেখানে জামায়াতের ‘ স্বাধীন সমাবেশের’ পক্ষে কথা বলা হয়ছিল। কিন্তু দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল।
যদিও মার্কিন প্রশাসন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সংঘবদ্ধ গণহত্যাকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। তখন নিক্সন প্রশাসন ইসলামাবাদের পক্ষ নিয়েছিল এবং এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানকে সহায়তায় বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।