চার দশক নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এলো দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনা ব্যাংকটির আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে গ্রাহকদের বিপুল আস্থা। বিশ্বস্ত এবং কল্যাণমূলক সেবায় গ্রাহকদের এই আস্থা করেছে ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগদানের মাধ্যমে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় মুসলিম দেশসমূহের আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার।
সে বছর জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আইডিবি সনদ স্বাক্ষর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বলিষ্ঠ ভূমিকায় বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংকরূপে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন পূরণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিতরণের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে নানাবিধ বিনিয়োগ সুবিধা দিচ্ছে এই ব্যাংক।
দীর্ঘ এই সময়ে ইসলামী ব্যাংক অর্জন করেছে অনন্য অর্জন।
রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ ব্যাংক
২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য এবং রেমিট্যান্স আহরণ করেছে যথাক্রমে ৭৫ হাজার ৪০৪ কোটি, প্রায় ৩৬ হাজার ৯৬৩ কোটি এবং প্রায় ৪৫ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে গত ৪০ বছরে দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স এসেছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বস্ত আমানতদার
বর্তমানের ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সঞ্চয়ের মানসিকতা তৈরি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মমূখী জীবনের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে দেশের প্রতিটি পরিবারের প্রয়োজন পূরণে কাজ করছে এই ব্যাংক।
কোটি গ্রাহকের আস্থা
ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অনন্য প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এই ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষে।
জাতীয় উন্নয়নের গর্বিত অংশীদার
প্রয়োজনভিত্তিক, উৎপাদনমুখী, শ্রমঘন, আমদানি-বিকল্প ও রপ্তানিমুখী খাতে বিনিয়োগ বহুমুখী করার মাধ্যমে সুষম ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে ইসলামী ব্যাংক। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৮৫ লক্ষ মানুষের।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পায়ন
দেশের ৬ হাজারের বেশি শিল্প কারখানা ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
এসএমই খাতে অর্থায়ন
ইসলামী ব্যাংক দেশের সর্বোচ্চ এসএমই বিনিয়োগকারী ব্যাংক। কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি সুষম-টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক এসএমই খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
আবাসন খাতে বিনিয়োগ
দেশের আবাসন বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার ১০% এর বেশি। ইসলামী ব্যাংকের আবাসন বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১২ লাখ মানুষের আবাসন নিশ্চিত হয়েছে।
পরিবহন খাতে বিনিয়োগ
বাংলাদেশের পরিবহন খাতের মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৮% মার্কেট শেয়ার ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত রেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যা বর্তমানে অর্ধ লক্ষাধিক। নৌপরিবহনে রয়েছে ৪২১টি। এছাড়া উড়োজাহাজ রয়েছে ৫টি।
পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প
ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সালে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সঞ্চয় গঠন, বিভিন্ন আয়-উৎসারী কর্মকান্ডে বিনিয়োগ কার্যক্রম রয়েছে। শহর এলাকার বস্তিবাসীসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২০১২ সাল থেকে ‘নগর দরিদ্র উন্নয়ন প্রকল্প’ কাজ করছে। ৩২ হাজার গ্রামে বিস্তৃত এ প্রকল্পের সদস্য ১৬ লক্ষ, যার ৯৪ শতাংশই নারী।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি
দেশের মোট স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টের ২১% এখন ইসলামী ব্যাংকের। হজ সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ক্যাশ ওয়াক্ফ অ্যাকাউন্ট, কারখানা শ্রমিক হিসাবসহ নানা সঞ্চয় হিসাবের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনেছে ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে ৩৯৪টি শাখা, ২২৯টি উপশাখা, ২৭০০টি এজেন্ট আউটলেট, ২৫০০টি এটিএম/সিআরএম বুথের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করছে।
প্রযুক্তিনির্ভর সেবা
ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম নিজস্ব সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত। ব্যাংকের কোর ই-আইবিএস সফটওয়্যার এই ব্যাংকের তরুণ প্রকৌশলীদের দ্বারা নির্মিত। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, বিকল্প ব্যাংকিং চ্যানেল, ই-কমার্স ইত্যাদি প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়াচ্ছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকগণ সকল লেনদেন করতে পারেন সহজেই।
সিএসআর কার্যক্রম
ইসলামী ব্যাংকিং মূলত একটি সামাজিক দায়বদ্ধ উদ্যাগ। গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের কল্যাণে ১৯৮৪ সালে ‘সাদাকাহ ফান্ড’ গঠিত হয়। পরে ব্যাপকভিত্তিক কাজের জন্য ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার অধীনে ১৯টি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউট সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
জাতীয় প্রণোদনায় ইসলামী ব্যাংক
কোভিড-১৯ মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় নীতিমালার অংশ হিসেবে প্রণোদনা প্যাকেজের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে ইসলামী ব্যাংক। এর মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, পোশাক খাত সহ অন্যান্য শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা পেয়েছে।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং বিষয়ক বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দি ব্যাংকার’-এর মূল্যায়নে ইসলামী ব্যাংক ২০১২ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংকরূপে স্থান পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় টানা ১২ বার ইসলামী ব্যাংক বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে এ তালিকায় ব্যাংকের অবস্থান ৮৮২তম। বিশ্বসেরা ইসলামিক ব্যাংক সিবাফি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইসলামী ব্যাংক। ট্যাক্স কার্ড সম্মাননা ২০২২, আইসিএসবি গোল্ড অ্যাওয়ার্ড, আইসিএমএবি বেস্ট কর্পোরেট গোল্ড অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃতি অর্জন করেছে ইসলামী ব্যাংক।
কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে অবদান
বর্তমানে কৃষি ও পল্লী ঋণে বিনিয়োগ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সারাদেশের ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৩ হাজার মাঠকর্মী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের অর্থায়নে ২৬টি পাটকল পরিচালিত হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের ১৭%-এর বেশি উৎপাদিত হয় ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে। পচনশীল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য অর্ধশতাধিক কোল্ড স্টোরেজে অর্থায়ন করেছে। ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে স্থাপিত হয়েছে ৮৫২টি অটো রাইস মিল। দেশের প্রথম অটো রাইস মিল ও ব্রান অয়েল মিল (ধানের তুষ থেকে ভোজ্য তেল কারখানা) স্থাপনে প্রথম অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংক।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আর্থিক সেবার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। পরিপূর্ণ প্রয়োগ ঘটেছে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে লেনদেন সুবিধা প্রদান করছে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং। যা গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিচ্ছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভূমিকা রাখছে।