গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে সংশোধনী এনে এতে সরকারের মালিকানা কমানো হয়েছে। সরকারের মালিকানা ২৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকের সুবিধাভোগীর জন্য রাখা হয়েছে ৯০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার এই অধ্যাদেশের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
এ ছাড়া দেওয়ানি কার্যবিধি, ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, সরকারি হিসাব নিরীক্ষা এবং রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের খসড়াসহ দুটি চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মোট চারটি অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
অর্থনৈতিক অপরাধের বিষয়ে কমিটি হচ্ছে
রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেসব গোষ্ঠী অর্থনৈতিক অপরাধ (ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম) করেছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অভিন্ন জলরাশির পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুটি আইন রয়েছে। এর একটিতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক সংশোধন অধ্যাদেশের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আগে গ্রামীণ ব্যাংক একটি মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করত। সেটি হলো, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধাভোগী তাদেরই গুরুত্ব থাকবে। তবে বিগত সময়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। তখন তাঁর দর্শন থেকে সরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশ নেওয়া হয়। এখন যে অধ্যাদেশ সংশোধন করা হলো তাতে আগে গ্রামীণ ব্যাংক শুধু ভূমিহীনদের জন্য কাজ করত, এখন বিত্তহীনদের নিয়েও কাজ করবে। আর পরিচালনা বোর্ডের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধাভোগী তাদের মধ্যে ৯ জন নির্বাচিত হয়ে আসবেন। পরে এই ৯ জনের মধ্যে থেকে তিনজন মনোনীত হবেন। তাদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন।
পরিশোধিত মূলধন আগে সরকারের ছিল ২৫ শতাংশ, সুবিধাভোগীর ছিল ৭৫ শতাংশ। এখন সরকারের থাকবে ১০ শতাংশ, সুবিধাভোগীর ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংককে জনস্বার্থ সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করার বিধান আনা হয়েছে বলে জানান রিজওয়ানা।
দেশের প্রান্তিক ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীর কাছে জামানত ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩’-এর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করে ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করে। বর্তমানে ব্যাংকটি ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩’ মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩’ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রণীত ‘গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদ চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে।
আলাদা হচ্ছে রাজস্ব নীতি-ব্যবস্থাপনা
রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাজকে আলাদা করা হচ্ছে। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত হবে।
আধুনিকায়ন হচ্ছে দেওয়ানি কার্যবিধি
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি বা সিপিসিতে আধুনিকায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন থেকে সমন জারি টেলিফোন, এসএমএস বা অন্য আধুনিক পদ্ধতিতে করা যাবে। আগে ভুয়া মামলার জন্য শাস্তি ছিল ২০ হাজার টাকা জরিমানা। এখন সেটি বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দেওয়ানি কার্যবিধি বা সিভিল প্রসিডিউর কোডে (সিপিসি) কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছিল। তারই আলোকে ব্রিটিশ সরকারের সময় প্রণীত সিপিসিতে কিছু পরিবর্তন আনার জন্য নীতিগত অনুমোদন হয়েছে।
সিপিসির কিছু সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগে একটি মামলার রায় হওয়ার পরও জারি-মোকদ্দমা করতে হতো সেই মামলার রায় বাস্তবায়নের জন্য। এখন বলা হচ্ছে, যখন রায় হবে, তখনই এই পিটিশনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হবে। আগে বারবার সময় নেওয়া হতো, এখন বলে দেওয়া হবে সর্বোচ্চ কয়বার সময় নেওয়া যাবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারি হিসাব নিরীক্ষা অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কিছু মানদণ্ড আছে, সেই মানদণ্ড যেন বাংলাদেশেও মেনে চলা হয়, সেটি নিশ্চিত করা; যাতে সরকারি অর্থের সঠিক ব্যয় নিশ্চিত করা যায়।
শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি আনার জন্য ব্যাংক রেজুলেশন
ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশের বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, একটি শিল্পগোষ্ঠী কয়েকটি ব্যাংকের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অনেক টাকা দেশ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এটি আর না হয়, সে জন্য ব্যাংকিং ও করপোরেট খাতে শৃঙ্খলা এবং জবাবদিহি আনতে এবং আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকার আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।