বাংলাদেশের রাজনীতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা এখন পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো একই প্ল্যাটফর্মে থাকলেও অবস্থানগত বিভাজন মাঠের রাজনীতিকে দুর্বল করে তুলছে। বিশেষ করে গণভোটের সময়সূচি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মতবিরোধ আস্থাহীনতা আরও বাড়িয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনকে অপরিহার্য মনে করছে। তাদের যুক্তি হলো, বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো জনগণের আস্থার বাইরে রয়েছে, ফলে প্রথমে গণভোট হলে জনগণ সরাসরি মতামত প্রকাশ করতে পারবে, আর তার ভিত্তিতেই নির্বাচনে নতুন আস্থা তৈরি হবে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনকে তারা অকার্যকর বলছে, কারণ দেশের নির্বাচনী বাস্তবতায় কেন্দ্র দখল, ভোটের চাপ, ভোটগ্রহণের গতি-এসব মিলিয়ে এমন ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে বিএনপি স্পষ্ট ভাষায় বলছে নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের পৃথক গণভোট হওয়া সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা চায়, প্রথমে সংসদ নির্বাচন, এরপর গণভোট, অথবা উভয়ই একই দিনে হতে পারে। বিএনপি আরও বলছে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে সংলাপে আহ্বান জানাতে পারে কেবল সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তাই জামায়াতের আলোচনার প্রস্তাবকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি এটাকেও উল্লেখ করেছে যে সরকার এক সপ্তাহের সময়সীমা দিয়ে আলোচনার আহ্বান জানানোকে কৌশলগত চাপ হিসেবে ব্যবহার করছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটাকে তারা বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও তারা নিজেরাই বিভক্ত। কেউ মনে করছেন একদিনে নির্বাচন ও গণভোট করলে ব্যয়, সময় ও প্রশাসনিক জটিলতা কমবে। আবার অন্যরা বলছেন, এতে সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলো রাজনীতিকরণের ঝুঁকিতে পড়বে। দলগুলো সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনে অনিচ্ছুক। তবে সরকার মনে করছে শেষ পর্যন্ত সমঝোতার পথ তৈরি হবে।
বিরোধী জোটের ভেতরে সমন্বয়হীনতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এনসিপি গণভোটের সময় নিয়ে নমনীয় অবস্থানে থাকলেও জুলাই সনদের “নোট অব ডিসেন্ট” বাতিল করার শর্ত রেখেছে। এবি পার্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চ চেষ্টা করেছিল বিএনপি–জামায়াত দূরত্ব কমাতে, কিন্তু দুপক্ষের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে কৌশলগত সংশয় আরও গভীর হয়েছে। জামায়াত মনে করছে বিএনপি নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দুই পক্ষের এই পারস্পরিক সন্দেহ বিরোধী প্ল্যাটফর্মকে দুর্বল করছে।
এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে যেতে পারে তা নিয়ে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা সামনে আসে। সবচেয়ে বাস্তবানুগ যে সমাধানটি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, তা হলো একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন। এতে বিএনপির সাংবিধানিক অবস্থান এবং জামায়াতের গণভোটের দাবি দুটোই আংশিকভাবে পূরণ হবে। সরকারও চাপমুক্ত একটি অবস্থান নিতে পারবে। তবে এই সমাধানে চূড়ান্ত ঐক্যমত্য এখনো দৃশ্যমান নয়।
নির্বাচনের আগে আলাদা গণভোট আয়োজন হলে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। বিএনপি কঠোর বিরোধিতা করবে, জামায়াত রাস্তায় নামবে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ কারণে রাজনৈতিকভাবে এটি সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে সরকার কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে পারে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের “শেষ রাতের চুক্তি” অপরিচিত নয়, তবে বর্তমানে অবস্থানের কঠোরতা দৃশ্যমান।
সবচেয়ে কম চাওয়া হলেও সম্ভব একটি পথ হলো সরকার দলগুলোর অবস্থান উপেক্ষা করে একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা। এতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে যেতে পারে, নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল হতে পারে, এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরও বাড়তে পারে।
সমগ্র বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতি একটি অস্বস্তিকর ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে। বিরোধী শিবিরের ভেতরের বিভাজন, সরকারের অনড় অবস্থান, এবং গণভোট ইস্যুতে পারস্পরিক অবিশ্বাস-সব মিলে জাতীয় নির্বাচনের পথ এখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে বাস্তবতার নিরিখে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ মনে হচ্ছে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা, কারণ এটিই তিন পক্ষের জন্য ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে কমিয়ে আনতে পারে।
লেখক: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট।





