পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে রাজধানী ইসলামাবাদে হাইকোর্টের বাইরে থেকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা ইমরান খানকে দুর্নীতির এক মামলায় গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
লাহোর আর করাচিতে পুলিশ মি. খানের সমর্থকদের লক্ষ্য করে জল কামান এবং কাঁদানে গ্যাস ছেড়েছে। বিক্ষোভ হচ্ছে পেশাওয়ারেও।
ইসলামাবাদের রাস্তায় শতশত বিক্ষোভকারী রাজধানী থেকে বেরনর ও ঢোকার প্রধান মহাসড়কটি অবরোধ করে রেখেছে। পিটিআই সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জল কামান ছুঁড়েছে।
মানুষ রাস্তার সাইন উপড়ে ফেলেছে এবং রাস্তার ওপর দিয়ে চলাচলের ব্রিজ ভেঙে ফেলেছে, বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পাথর ছুঁড়েছে। সেসময় ঘণ্টাখানেকের মত ওই এলাকায় থাকা বিবিসির সংবাদদাতা সেখানে পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তাদের দেখেননি।
মি. খানের সমর্থকরা বেশ কিছু শহরে সুরক্ষিত সেনা ছাউনির বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন ইমরান খানকে গ্রেফতার করায় তারা ক্ষুব্ধ। “আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে,” বলছেন ফরিদা রওদাদ।
“আমরা আর কী করতে পারি? পাকিস্তানে আর কী করার আছে? আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কখনও কোন কথা বলিনি, বললে হয়ত ভাল করতাম!
“এখন একটা নৈরাজ্য চলুক, বিশৃঙ্খলা ঘটুক। ইমরান না থাকার মানে পাকিস্তানে আর কিছু নেই। ক্ষমতা হাতে নেবার মত আর কেউ এখানে নেই।”
ইসলামাবাদের পুলিশ সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছে পাঁচজন পুলিশ অফিসার আহত হয়েছে এবং ৪৩জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
টুইটারে পোস্ট করা লাহোরে বিক্ষোভের ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে সামরিক বাহিনীর কমান্ডারের বাসভবন জনতা ঢুকে পড়েছে এবং আসবাবপত্র ও বাসার ভেতরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে।
রয়টার্স খবর দিচ্ছে প্রধান বন্দর শহর করাচিতে বিক্ষোভকারীরা প্রধান সড়ক অবেরাধ করে রেখেছে।
রয়টার্স বলছে দক্ষিণ পশ্চিমের কোয়েটা শহরে মি. খানের সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষে ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তা সহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে।
১৫ই মার্চ লাহোরে তার বাসভবনে এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মি. খান বলেন সরকার তাকে কারাগারে বন্দি রাখতে চায় যাতে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন
আজ (মঙ্গলবার) ইসলামাবাদে আদালত চত্বর থেকে ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মি. খান আজ আদালতে হাজিরা দেন। তিনি বলছেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
গত বছর এপ্রিল মাসে মি. খানকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরাখাস্ত করা হয়। সেসময় থেকে তিনি আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এবছর আরও পরের দিকে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হবার কথা।
পাঞ্জাব পুলিশের মহাপরিচালক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন “দুর্নীতি ও অনিয়মের” অভিযোগে মি. খানকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ৫০ বিলিয়ন রুপির বৈধতা দেওয়ার বিনিময়ে কয়েক বিলিয়ন রুপি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইমরান খান এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। সেই মামলাতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
মি. খান কোনরকম আইনভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তাকে গ্রেফতার করার আগে রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন তিনি তার বিরুদ্ধে নেয়া যে কোন পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আছেন।
ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হবে কি হবে না এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে মি. খানের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী তার লাহোরের বাসভবনে এর আগে বেশ কয়েকবার তাকে আটক করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে বারবার বাধা দিয়েছে ইমরান খানের সমর্থকেরা।
চলতি বছরের মার্চ মাসেও ইমরান খানকে গ্রেফতারে অভিযান চালিয়েছিল দেশটির পুলিশ ।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন তখন তাদের খবরে জানায় যে ইমরান খানের দলের এক নেতা এই অভিযান বন্ধ করার জন্য পিটিশন দায়ের করলে আদালত পুলিশের অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু পাঞ্জাব প্রদেশের তথ্যমন্ত্রী আমির মির বিবিসিকে তখন বলেছিলেন লাহোরের একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যাতে ঠিক মতো হতে পারে সেজন্য পুলিশ মি. খানকে গ্রেফতারের অভিযান স্থগিত করে।
এর আগে ইমরান খান বলেন যে তার বাসভবনে আধাসামরিক বাহিনীর এই অভিযানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে দেশটির বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগে মি. খানের বিরুদ্ধে করা এক মামলায় আদালতে উপস্থিত না হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল।
ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্রীয় উপহার সামগ্রী বেআইনিভাবে বিক্রি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে মি. খান বলেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের একজন মন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব তখন বলেছিলেন যে ইমরান খানকে গ্রেফতারের চেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং দুর্নীতির মামলায় আদালতের নির্দেশ অনুসারে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল।
তিনি তখন অভিযোগ করেছিলেন যে গ্রেফতার এড়াতে মি. খান তার দলের কর্মী, নারী ও শিশুদের মানব-ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং উত্তেজনা ছড়িয়েছেন।
হত্যার চেষ্টার অভিযোগ
গত নভেম্বর মাসে সমাবেশ চলাকালে তাকে হত্যার চেষ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে দায়ী করেন ইমরান খান। তাকে হত্যা চেষ্টায় গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষ এক কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগও তুলেছিলেন মি খান। সামরিক বাহিনী ওই অভিযোগ অস্বীকার করলে ইমরান খান মঙ্গলবার আদালতে যাবার আগে এক ভিডিও বার্তায় জোর দিয়ে আবারও ওই অভিযোগ তোলেন।
“আমার মিথ্যা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই ব্যক্তি আমাকে দুই বার হত্যার চেষ্টা করেছে। আর যখন তদন্ত হবে আমি প্রমাণ করবো যে ওই ব্যক্তি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছেন এবং তার সাথে পুরো এক বাহিনী জড়িত। সবাই জানে যে কে তিনি। আমার প্রশ্ন হলো- একটি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কি এফআইআর করার কোনও অধিকার নেই?”- ভিডিওতে এমন বক্তব্য দেন তিনি।
প্রায় সাত মিনিটের ওই ভিডিওতে নানা অভিযোগ করেন ইমরান খান। এরপরই তাকে আদালত চত্বর থেকে আটক করা হয়।
মি. খান তাকে হত্যার চক্রান্ত করার জন্য সেনা বাহিনীর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ করার পর গতকাল সোমবার সামরিক বাহিনী তাকে “ভিত্তিহীন অভিযোগ” করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেয়। বাসস।