শুক্রবার, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন: সম্ভাবনা, সংকট ও উত্তরণ

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চারদিকে চলছে নানা আলোচনা। কেউ বলছেন-এবার একটা সুষ্ঠু ভোট হবে, কেউ বলছেন-সব আগের মতোই চলবে, আবার কেউ ভয় পাচ্ছেন-নির্বাচন না হলে বড়ো সঙ্কট তৈরি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে কী হতে পারে? দেশ কি নতুন করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পাবে, নাকি আরও বিভাজনের দিকে যাবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে সাধারণভাবে তিনট প্রকারের মতামত পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রথমত, যদি নির্বাচনটা সুষ্ঠু হয়, সব দল অংশ নিতে পারে, পুলিশ ও প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে, তাহলে একটা নতুন আস্থা ফিরে আসবে। মানুষ বিশ্বাস করবে-ভোট দিয়েই পরিবর্তন আনা যায়।

দ্বিতীয়ত, যদি নির্বাচনে কিছুটা অংশগ্রহণমূলক হয় কিন্তু প্রশাসনের আচরণ একপেশে থাকে, তাহলে ফলাফল বৈধ হলেও মানুষের মধ্যে সন্দেহ থাকবে। তখন সরকার টিকে যাবে, কিন্তু আস্থার সংকট থেকেই যাবে।

তৃতীয়ত, যদি নির্বাচনই না হয় বা বিরোধী দল অংশ নিতে না পারে, তাহলে সেটা বড় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সঙ্কটে রূপ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলেও তখন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

আমি মনে করি-নির্বাচন শুধু ভোটের দিন নয়, তার আগের সময়টাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন, পুলিশ, মিডিয়া-সব জায়গায় যদি পক্ষপাত দেখা যায়, তাহলে ভোটের ফল যেমনই হোক, মানুষ বিশ্বাস করবে না।

সরকারকে অবশ্যই দ্বৈতনীতি পরিহার করতে হবে। একদিকে “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই” বলা, অন্যদিকে কম পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ দেওয়া-এই নীতি জনগণের আস্থা ধ্বংস করে।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলকেও শুধু আন্দোলনের ভেতর সীমাবদ্ধ না থেকে গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে। যদি সত্যিই তারেক রহমান দেশে ফেরেন, সেটি রাজনৈতিকভাবে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। কিন্তু সেটা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও আইনি কাঠামোর ভেতরে, যাতে সংঘর্ষ না বাড়ে।

নির্বাচনের সময়ে পুলিশের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু সেই ক্ষমতার ব্যবহার হতে হবে দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছভাবে। মানুষকে মনে করাতে হবে-পুলিশ রাষ্ট্রের নয়, জনগণের পক্ষে। শক্তি প্রয়োগের আগে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। না হলে ভোটের মাঠ ভয় আর সন্দেহে ভরে যাবে।

নির্বাচন না হলে দেশ বড়ো সমস্যায় পড়বে। অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে, বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। এ অবস্থায় সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষেরই দরকার আলোচনায় বসা। রাজনৈতিক পক্ষের শর্ত মেনে না নিয়েও আলোচনার রাস্তা খোলা রাখা যায়-যদি দুপক্ষই দেশকে আগে রাখে, দলকে নয়।

সঙ্কট থেকে বেরোনোর পথ

১. আলোচনার টেবিল খোলা রাখতে হবে। বিরোধী দলকে দমন না করে সংলাপে আনতে হবে। সংলাপ মানে দুর্বলতা নয়-বরং দায়িত্ববোধ।

২. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। যদি মানুষ দেখে কমিশন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তাহলে ভোটের ওপর বিশ্বাস থাকবে না।

৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মিডিয়ার স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। বাইরের দুনিয়াকে দেখাতে হবে-বাংলাদেশ নিজেই ন্যায়সংগতভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে পারে।

৪. প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে স্বচ্ছতা না থাকলে, নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।

৫. রাজনৈতিক নেতাদের সহনশীল হতে হবে। দল বদল নয়, মনোভাব বদল-এটাই দরকার। একে অপরকে শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শিখতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনেক কঠিন সময় পার করছে। এখন প্রয়োজন সহনশীলতা, সংলাপ ও আস্থার রাজনীতি। নির্বাচন হোক-সেটা যেন হয় অংশগ্রহণমূলক, নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য।
কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু সরকারের পরিবর্তন আনে না, মানুষের মনেও আশা ফিরিয়ে আনে।
আর যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে সেই আশা হারিয়ে যাবে-যা কোনো দেশেই ভালো ফল দেয় না।

লেখক পরিচিতি: হাফিজ আল আসাদ । বিশ্লেষক ও সমাজ ভিক্তিক উন্নয়ন পরামর্শক, সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট, এমডিসি বাংলাদেশ ডিরেক্টর আর্থ ফাউন্ডেশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ