শুক্রবার, ১৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গোপালগঞ্জের ঘটনাকে ‘অশনি সংকেত’ বলছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে সহিংতা ও হতাহতের ঘটনার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। এই ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

গোপালগঞ্জে বুধবারের এই সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করলেও তাতে কাজ না হওয়ায় বুধবার রাত আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ দেয় সরকার। যা পরবর্তীতে আরো বাড়ানো হয়।

এই ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।

তারা বলছেন, গোপালগঞ্জের সহিংসতা কিংবা পুরোনো ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যার মতো ঘটনাগুলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই নতুন মাত্রা দিচ্ছে। এটি আসন্ন নির্বাচন পেছানোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

এই ঘটনার পেছনে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতাদেরও দায় দিচ্ছেন অনেকে।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের কারো কারো মতে, ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নাম দেওয়ার মাধ্যমে এনসিপির নেতারাও পরোক্ষভাবে এই হামলা-সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছেন।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

রাজনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ একদিকে আওয়ামী লীগকে যেমন লাভবান করেছে। তেমনি যারা নির্বাচন পেছাতে চায়, তারাও একটা সুযোগ পেয়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।

এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে একটি ‘অশনী সংকেত’ বলেও মনে করেন অনেক রাজনীতিবিদ।

পহেলা জুলাই থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি।

তাদের এই কর্মসূচিকে ঘিরে ওইদিন রাত থেকেই জেলাটিতে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরপরও বুধবার সমাবেশের আয়োজন করা হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক এলাকায়।

কিন্তু এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলার ঘটনা ঘটে। সমাবেশ শেষে ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে আবারো হামলার মুখে পড়ে এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর।

যা পরবর্তীতে রূপ নেয় সহিংস সংঘাতে। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় গোপালগঞ্জ ছেড়ে খুলনার দিকে রওয়ানা দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা।

এদিন দুপুর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ঘটে হতাহতের ঘটনা। যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই গোপালগঞ্জে ঘোষণা করা হয় কারফিউ।

এই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।

সম্মিলিতভাবে শাহবাগ ব্লকেড করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, জাতীয় নাগরিক পার্টি, যুবশক্তিসহ ছাত্র-জনতা।

এমন একটি সময়ে এই ঘটনা ঘটলো যখন সংস্কার, জুলাই সনদ ও নির্বাচন ঘিরে নানা আলোচনা চলছে দেশের রাজনীতিতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ কাটেনি।

এমন প্রেক্ষাপটে গোপালগঞ্জের সহিংস পরিস্থিতি দেশের রাজনীতিতে ‘অশনি সংকেত’ দিচ্ছে বলেই মনে করেন অনেক রাজনৈতিক নেতা।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে।

বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। আলাদা কর্মসূচি থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল।

বুধবার রাতেই জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় গোপালগঞ্জের উদ্ভুত পরিস্থিতিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার নীলনকশা বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি।

রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্তকতার সঙ্গে কর্মসূচি নির্ধারণের আহ্বানও জানিয়েছে তারা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে প্রতিশ্রুত সংসদ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। মব, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অযোগ্যতা ও নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফ্যাসিবাদি শক্তি ঠিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির মাথায় যে দুঃসাহস দেখিয়েছে এটা অপ্রত্যাশিত ছিল।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা করি নাই যে, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে এতো শিগগিরই এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সেটা গোপালগঞ্জে হোক বা অন্য কোথাও।”

এর কারণ হিসেবে সরকারের নির্লিপ্ততাকেই দায়ি করেন মি. আহমেদ। তার মতে, “সরকারের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।”

গোপালগঞ্জে সহিংসতার দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই দিচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আমি গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ে সরকারেরই দায় দেখি। সরকারের দায়িত্বহীন আচরণই এখানে সামনে চলে এসেছে।”

গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করতে নানা অপচেষ্টা চলছে, যা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে বলেও মনে করেন রুহিন হোসেন প্রিন্স।

এখান থেকে সরকারকে শিক্ষা নিতে বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলছেন তারা।

এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ তৈরি হচ্ছে বলেই মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। “আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উৎসাহ যোগাবে এই ঘটনা,” বলেন তিনি।

এনসিপি নেতাদেরকেও গোপালগঞ্জের ঘটনার দায় দিচ্ছেন মি. হক। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “তারা অন্যগুলোয় যাচ্ছে গণসংযোগ, গণসমাবেশ এটাতে নাম দিয়েছে মার্চ টু গোপালগঞ্জ, পরোক্ষাভাবে এক ধরনের উস্কানি এর মধ্যে কাজ করছে।”

একটি বিশেষ অঞ্চলের পরিস্থিতি, মানুষের রাজনৈতিক সামাজিক মনস্তত্বসহ অনেকগুলো বিষয় কাজ করে, যা বিবেচনায় রাখা উচিৎ ছিল বলেও মনে করেন তিনি।

“মুজিববাদের কবর দিতে হবে এই কথাটা গোপালগঞ্জে যেয়ে বলতে হবে কেনো?,” বলেন মি. হক।

তার মতে, পুরোনো ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপিকে ঘিরে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল। এই ধরনের ঘটনাগুলো নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন শঙ্কা থাকার পরও সরকার আগে থেকেই কেনো কার্যকর পদক্ষেপ নিল না- এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক দলের নেতাদের কেউ কেউ।

সাইফুল হক বলেছেন, “তারা তো (এনসিপি নেতারা) এক ধরনের পরোক্ষ সরকারি প্রটোকলেই সারাদেশে যাচ্ছেন। এখানেও নিশ্চয় সরকারের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে একটা উত্তেজনা আগে থেকেই আছে।”

“তার মানে কেউ না কেউ ঘটনাকে ঘটতে দিয়েছে,” বলেন মি. হক।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতিকেই দায়ি করছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।

এই ঘটনা জাতির জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করেন মি. পরওয়ার। তিনি বলছেন, “শুধু শেখ হাসিনা চলে গেলেই যে ফ্যাসিবাদ চলে গেছে, তা নয়- তার দল, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ এখনো রয়ে গেছে।”

“একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো দলের সরকার নয়, জনগণ তো আশা করে তাদের কাছে জানমাল নিরাপদ থাকবে, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারিদের কঠোর হস্তে দমন করবে, সেটা কিন্তু দেখা যায়নি,” বলেন মি. পরওয়ার।

বিবিসি নিউজ বাংলা

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ