ভারতের এক বিশিষ্ট সাংবাদিক দাবি করেছেন, রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করতে না পেরে ক্ষমতা দখলের জন্য বিদেশি সমর্থনসহ গোপন কৌশল অবলম্বন করছে বিএনপি। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গেও বৈঠক করেছে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে দিল্লিকে প্রস্তাব দেয় প্রতিনিধি দলটি। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ভারতীয় সংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত দ্য প্রিন্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমার কাছে তথ্য আছে, গত ২৬ আগস্ট ভারতের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল সিঙ্গাপুরে বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস ও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
তিনি বলেন, তারেক কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাদের সমর্থন চেয়েছেন। তিনি (তারেক) তাদের বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আমাদের সাথে আছে। আমরা তার পূর্ণ সমর্থন পাব। অনুগ্রহ করে আমাদের সাহায্য করুন।’
সুখরঞ্জন বলেন, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে এবং এরপর সেই বাঙালিদের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। তারা যে এখন তারেক ও জামায়াতকে সমর্থন দেবে এবং বাংলাদেশিদের ক্ষতি করবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তারেক রহমান এখনও নিয়মিত কথা বলে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে (বিদেশিদের সঙ্গে) বৈঠকও করছেন।
এই বিশ্লেষক বলেন, যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে বিএনপি। তারা আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে ভারতসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশের দুর্নীতির রাজপুত্র’ হিসেবে পরিচিত পলাতক তারেকের আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যোগাযোগ রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সঙ্গেও। সিআইএ কর্মকর্তাদের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি নিয়েও আপত্তিকর কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াই উচিত হয়নি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য সুপরিচিত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ভয়াবহ ও নজিরবিহীন সেই হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তিনি। একই বছরে দেশের আলোচিত চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের ঘটনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তারেক।
তারেক রহমান দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন। ২০০১-৬ সাল পর্যন্ত তার মা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে পরবর্তীতে শাস্তিও পেয়েছেন তিনি।
তারেক রহমান লন্ডন থেকেই তার বাবা বাংলাদেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকারবিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করার।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত জানান, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে গিয়ে তারেক প্রায়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তারেক পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধান, আমেরিকার সিআইএর বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেসব বৈঠকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন তিনি।
ভারতীয় এ সাংবাদিক বলেন, ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধার পরিকল্পনাও আছে তারেকের এবং এ বিষয়ে আমেরিকার সাহায্যও চেয়েছেন তিনি। ভারতের গোয়েন্দারা বিশ্বাস করে, তারেকের তত্ত্বাবধানেই কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারে হামলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ভারতীয় কর্মকর্তারা তারেকের বিরুদ্ধে দুবাইয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সাথে বিভিন্ন পরিকল্পনা করার অভিযোগও এনেছেন। তারা বলেন, তার পরিকল্পনা হলো জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং তাদের ভারতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য ব্যবহার করা। ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারেক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে লাখ লাখ ডলার-পাউন্ড গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
‘তারেক, দ্বিতীয় বিন লাদেন’
সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুখরঞ্জন বলেন, বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তারেক ভারতের ১৬টি রাজ্যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। সেই সময়, তারা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করে এবং যে দলটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল সেই জামায়াতে ইসলামীকে দিয়ে দেয়।
তিনি বলেন,
তারা (বিএনপি সরকার) সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে সব আয়োজনই করেছিল।
তার মতে, ভারতীয় প্রতিনিধি দল বিএনপির তিন নেতার সঙ্গে বৈঠকে উল্লেখ করেছেন যে, কীভাবে খালেদার নেতৃত্বাধীন সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে এবং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বৈঠকে ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, তারেক হলো দ্বিতীয় বিন লাদেন…তাকে দল থেকে বের করে দাও…তাকে আবার বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া উচিত নয়…এবং বিএনপির উচিত জামায়াত, হেফাজতে ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং জঙ্গিবাদকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা। তবেই আমরা বিবেচনা করব (আলোচনার জন্য বসব)। তারেককে আবার ক্ষমতায় আসতে দেয়া যাবে না।
তবে বিএনপির প্রতিনিধি দল তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি এবং বলেছে ঢাকায় আলোচনার পর তারা ভারতীয় কর্মকর্তাদের জানাবে, বলেন সুখরঞ্জন।
‘কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ’
২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরই তারেকের তৎপরতা শুরু হয়। দলের রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর ‘হাওয়া ভবনে’ একটা বিকল্প সরকার পরিচালনা করতেন তিনি।
ওয়াশিংটনে পাঠানো ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির তারবার্তায়ও উঠে এসেছে বিষয়টি। ২০০৮ সালে উইকিলিকসে এসব তারবার্তা ফাঁস হয়। এর মধ্যে এক তারবার্তায় মরিয়ার্টি তারেককে ‘কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ ও সহিংস’ ব্যক্তি বলে বর্ণনা করেছেন। মরিয়ার্টি আরও লিখেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, তারেক ‘গুরুতর রাজনৈতিক দুর্নীতির’ জন্য দোষী। তাকে সরকারি ক্রয় ও নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘স্পষ্টভাবে ও ঘন ঘন ঘুষ দাবি করার জন্য কুখ্যাত’ বলেও বর্ণনা করেন মার্কিন এ কূটনীতিক।
তারবার্তায় মরিয়ার্টি আরও বলেছিলেন, আইনের শাসনের প্রতি তারেকের প্রকাশ্য অসম্মান বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি শক্তিশালী করেছিল। সেই সাথে দারিদ্র্য বাড়িয়েছিল ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছিল। তার কাছে কোটি কোটি ডলারের অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন,সংক্ষেপে, বাংলাদেশে যা কিছু সমস্যা তার জন্য অনেকটাই দায়ী করা যেতে পারে তারেক ও তার সহযোগীদের।
২০০৭ সালে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তারেককে গ্রেফতার করা হয়। তবে পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান।
বাংলাদেশের সাফল্যে ঈর্ষা বিএনপি ২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে। এ সময়ে দেশের যে অগ্রগতি ও উন্নয়ন হয়েছে, তা মানতে পারছে না দলটি। আর তাই সেই শুরু থেকেই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার নিন্দা করে আসছে তারা। একই সঙ্গে যে সরকারের হাত ধরে এতসব উন্নয়ন সেই সরকারের বিরুদ্ধেই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কিছু ভারতীয় ওয়েব পোর্টাল, ম্যাগাজিন ও ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশের অর্জনকে খাটো করার ষড়যন্ত্র করেছে দলটি।
সেসব প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্যে বড় তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছে।
তিনি জানান, সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক বৈঠকে গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে গুজব সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য মোটা অর্থ দিয়েছেন তারেক রহমান।
ভারতীয় এ সংবাদিক বলেন, এই শক্তি (বিরোধীদল) এখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ শক্তির নেপথ্যে কে কী লিখছে, তাকে এত গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
তার মতে, গুরুত্ব দেয়া মানেই যে লিখেছে তাকে গুরুত্ব দেয়া, যে ষড়যন্ত্র করছে তাকে গুরুত্ব দেয়া। আল কায়েদার মতো সংগঠনের সঙ্গে যাদের সংযোগ, তারা গুজবের মতো হাতিয়ার বেছে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কালিমা দেয়ার চেষ্টা করবে এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
বিএনপি সবসময়ই বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জনগণের ওপর বিশ্বাস নেই বিএনপির। ক্ষমতায় যেতে তারা সবসময়ই বিদেশিদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে।
সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত সময় সংবাদকে বলেন, গত ১০ বছরেও এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে। বিএনপি বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে বিদেশিদের আহ্বানও জানিয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল সিঙ্গাপুরে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সাহায্য চাওয়ায় তিনি বিস্মিত নন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে, ২০১৩ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত কীভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে তা আলোচনার জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন। তার এই পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
সিনিয়র এ সাংবাদিক বলেন, এটি স্বাভাবিক যে একটি দেশ তার প্রতিবেশী দেশের ঘটনা সম্পর্কে জানবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন রয়েছে। বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য বিএনপির অনুরোধে ভারত কখনো সাড়া দেবে বলে আমার মনে হয় না।
অজয় দাশগুপ্ত বলেন, এ ধরনের অনুরোধ দেশ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং দলের জন্যই ক্ষতিকর। এটা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।