২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। বাঙালিদের কাছে দিনটি অত্যন্ত গৌরবের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যদিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে এক শ্রেণির অর্বাচীনেরা দীর্ঘদিন ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কারণ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার একমাত্র বৈধ এখতিয়ার ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলার জনগণ তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু জানতেন কখন,কোন সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে। তিনি সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন, শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। ২৫ মার্চ যখন অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে,ঠিক তখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং বলেন,‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই,আপনারা যেখানেই থাকুন,আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি খেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটি উৎখাত করা এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রেরিত তারবার্তাটি মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে।প্রেরিত বার্তাটি কপি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিলি করা হয়।২৬মার্চ পাকিস্তান বেতারের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা শহর থেকে অনেক দূরে নিরাপদ জায়গা কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন।সেখানেই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম সম্প্রচারিত হয়।বঙ্গবন্ধুর নামে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।’তারপর ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সিন্ধান্তে মেজর জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।সেটাই প্রকৃত ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পরদিনই বিশ্বের অন্তত ২৫ টি দেশের শতাধিক গণমাধ্যমে খবর করেছে।ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলেছে,‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’দ্য ডেইলি টাইমস বলেছে,‘বাঙালি জাতির সর্বাধিনায়ক নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন,‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
ভয়েস অব আমেরিকা বলেছে,‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছ।শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।’দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান বলেছে,‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে,সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের পদক্ষেপ।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান বলেছে,‘একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’আর্জেন্টিনার বুয়েন্স হেরাল্ড বলেছে,‘বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে মুজিব।
‘নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে,‘স্বাধীনতার ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস বলেছে,বঙ্গবন্ধুর ছবি সহ স্বাধীনতার ঘোষণার কথা শিরোনাম করে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি(ডিআইএ)-এর রিপোর্টেও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা উল্লেখ করা হয়েছে।রিপোর্টের ৪৩ এর ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এছাড়া ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন।নিষিদ্ধ করা হয় তাঁর দল আওয়ামী লীগকে।পাকিস্তান সরকার স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য বঙ্হবন্ধু ছাড়া আর কাউকেই শত্রু বলে নি,দোষারোপ করেনি।
১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন টিক্কা খান।যার নির্দেশে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা শুরু হয়।তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, স্যার শুনুন!শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’এবং আমি নিজেও রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি।শেখ সাহেবের কন্ঠ আমি ভালো করেই চিনতাম।শেখ সাহেব গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। টিক্কা খানের পর এপ্রিল মাসে গভর্নরের দায়িত্ব নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী।এই দুই গভর্নরের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন সিদ্দিক সালিক।
তিনি তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’গ্রন্থে বলেছেন,‘ঢাকায় যখন প্রথম গুলি বর্ষিত হলো ঠিক সেই মুহুর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে এলো।ওই কন্ঠের বানী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল।তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।সংবিধানের ১৫০(১) অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হবে।সেই ঘোষণাপত্রেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথ ভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’২০১১সালের ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দান করেছে। যার ফলে ঘোষণাপত্রটি সংবিধানের একটি অসংশোধনযোগ্য বিধানে পরিনত হয়েছে। এখন এই ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ। যারা বিতর্ক সৃষ্টি করে দেশে বিভক্তি তৈরি করতে চান,তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় কোন প্রশ্ন তুলেন নি।বরং তার লেখা কিংবা বক্তব্যে বারবার প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল।বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন।কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ঘোষক তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসে।বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে গিয়ে জিয়াকে-ই প্রকারন্তরে ছোট করা হয়।জিয়া মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অধীনে চাকরি করেছে।মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বীর উত্তম খেতাব পেয়েছে।বিএনপির অর্বাচীনরা ক্ষমতার লোভে তাদের নেতার অবদানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
পৃথিবীতে যেসব দেশ সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে,সেসব দেশের একজন জাতীয় বীর বা মহানায়ক আছেন।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন,রাশিয়ার লেলিন,ভারতের মহাত্মা গান্ধী,ভিয়েতনামের হো চিন মিন,ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নো,কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো,কম্বোডিয়ার নরোডম সিহানুক,দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া যেমন সেসব দেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না,ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব নেই। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর নামেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তিনি শারিরীক ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত থাকলেও ছিলেন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
লেখক:সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল:haldertapas80@gmail.