সৈয়দপুর বিমানবন্দরের বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সিনিয়র এরোড্রাম অফিসার সুপ্লব কুমার ঘোষ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। ঘুষ, চাঁদাবাজির সাথেও জড়িত এ কর্মকর্তা। দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা কেপিআই নীতিমালার কোন তোয়াক্কা না করায় বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে। এসব অভিযোগের পরেও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সুপ্লব কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সম্প্রতি সুপ্লব কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে মামলাসহ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির ফিরিস্তি তুলে ধরে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক (সিনিয়র এরোড্রাম) সুপ্লব কুমার ঘোষ ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর হতে কর্মরত রয়েছেন। এ কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই তিনি বিভিন্ন অনিয়ম, ঘুষ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া বিমানবন্দর পার্কিং এলাকায় পার্কিং সুবিধা দিয়ে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ড্রাইভারদের নিকট থেকে নিয়মিত উৎকোচ গ্রহণ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কেপিআই নীতিমালা ভঙ্গ করায় বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির মুখে রয়েছে। দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম ভাঙ্গিয়ে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি করে প্রায় ৪ বছর ধরে বহাল তবিয়তে আছেন সুপ্লব কুমার ঘোষ। তার টিকে থাকার খুঁটির জোর কোথায় এমন প্রশ্ন ঘুরছে সৈয়দপুরের সর্বত্র।
এছাড়া বিমানবন্দরস্থ লাউঞ্জ এবং রেস্টুরেন্টসমূহ হতে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছেন সুপ্লব কুমার ঘোষ। কার পার্কিংয়ের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান বেলাল এন্টারপ্রাইজ হতে ইজারা মূল্যের অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেন তিনি । বর্তমানে তার (সুপ্লব কুমার) বিরুদ্ধে নীলফামারী জজ কোর্টে চাঁদাবাজি মামলাসহ ৩ টি মামলা চলমান রয়েছে।
সৈয়দপুর বিমানবন্দরের চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ দায়সারাভাবে কাজ করছেন ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষ। এরফলে এসব কাজ খুবই নিন্মমানের হচ্ছে। ইতোমধ্যে নবনির্মিত দেয়ালে ফাটল, প্লাস্টার ফুলে উঠা এবং ভিআইপি লাউঞ্জের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।
২০২১ সালের ১ মে সৈয়দপুর বিমাবন্দরের রানওয়েতে লাইটের মোটর ঢেকে রাখার জন্য ৯৫ টি স্লাব/ ঢাকনা তৈরি করা হয়। ব্যবস্থাপকের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত এ কাজে পরিত্যক্ত রড, সিমেন্ট, বালু দিয়ে স্লাব/ঢাকনা তৈরী এবং ঢালাইয়ের পুরুত্ব ৬ ইঞ্চির স্থলে ২.৫ ইঞ্চি দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারি মালামাল বিক্রি করে এ অর্থ নিজে ভোগ করে থাকেন। সুপ্লব কুমার ঘোষ কর্তৃক তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগকৃত মোমিন মোকছেদুলের মাধ্যমে বিমানবন্দরের ঠিকাদারি কাজ হতে বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে টাকা আদায় করে থাকেন।
বিমানবন্দরে কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ এন্ড সন্স এর স্বত্বাধিকারী শিপন এর নিকট হতে অবৈধভাবে ১০ লক্ষ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত উপদেষ্টার মাধ্যমে বিমানবন্দর সংলগ্ন ওয়েলফেয়ার মার্কেটের ৩৯টি দোকান থেকে দোকান প্রতি তিনি ৪০ হাজার টাকা দাবী করেন।
সম্প্রতি সুপ্লব কুমার ঘোষ সৈয়দপুর বিমানবন্দরের “এমটিবি লাউঞ্জ, নকশিকাঁথা লিমিটেড” এর এক্সিকিউটিভ মোঃ মাহমুদুল হাসানের সহায়তায় ২,৫০,০০০ টাকা ঘুষের বিনিময়ে মোঃ রকনুজ্জামান পলাশ নামক এক ব্যক্তিকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে লিফটম্যান হিসেবে চাকুরী প্রদান করেন। রকনুজ্জামান প্রায় দেড় বছর যাবত অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে চাকুরী করে আসছিল। পরবর্তীতে পদটি বিলুপ্ত দেখিয়ে এবছরের ৩০ জুন (২০২৩) হতে তাকে চাকুরি হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। এতে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।
সুপ্লব কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মচারীদের ওভারটাইম কেটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। কর্মচারীরা পূর্বে মাসিক ১৭০ ঘণ্টার ওভারটাইম পেলেও বর্তমানে তাদেরকে ১২০ ঘণ্টা ওভারটাইম দেয়া হচ্ছে। বিমানবন্দরে কর্মরত কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম তাকে এই কাজে সহযোগিতা করে বলে জানা গেছে।
সুপ্লব কুমার বিমানবন্দরের বিভিন্ন কাজ করার নাম করে বিল ইস্যু করে টাকা নিয়ে থাকেন। পানির ফিল্টারের কোম্পানির লোকের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তাদের থেকে ডোনেশন নিয়ে বিমানবন্দরে ফিল্টার স্থাপন করা হলেও সুপ্লব কুমার কর্তৃপক্ষ বরাবর সেই ফিল্টার বাবদ বিল করে টাকা আদায় করেছেন।
এছাড়া বিমানবন্দরের বিভিন্ন জায়গায় জন্মানো ঘাস/শন পরিস্কার করার জন্য তিনি বহিরাগত লোকদের নিয়ে আসেন, যারা বিনা পারিশ্রমিকে নিজেদের প্রয়োজনে ঘাস/শন কেটে নিয়ে যায়। কিন্তু সুপ্লব কুমার ঘাস/ শন পরিস্কার বাবদ বিল উত্থাপন করে কর্তৃপক্ষের নিকট হতে মোটা অংকের বিল নিয়ে থাকেন।
ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষের অনুকূলে সরকারিভাবে ‘জে’ টাইপ কোয়ার্টারে বাসা বরাদ্দ থাকলেও তিনি সেখানে বসবাস না করে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির রেস্ট হাউজে প্রায় ১ বছর ধরে অবস্থান করছেন।
আকাশ পথে নিরাপদে বিমান চলাচলের জন্য সিভিওআর এর পরিবর্তে বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির ডিভিওআর ব্যবহৃত হচ্ছে। এ জন্য পূর্বে ব্যবহৃত সিভিওআর ভাঙ্গার দরপত্র পেয়েছে আরএন্ডআর কোম্পানী। সুপ্লব কুমার ঘোষ ইতোপূর্বে ব্যবহৃত সিভিওআর বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে ফেরত প্রদান না করে এর পরিত্যক্ত মূল্যবান সামগ্রী নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিজের অধীনে রেখে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনাল সাইডে একটি অস্থায়ী টিনসেড ঘর নামাজ ও ওজু খানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ড্রাইভার ও পরিদর্শনে আসা সাধারণ নাগরিক এবং সাধারণ যাত্রীগণ সেখানে নামাজ আদায় করত। কিদ ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ নামাজের ঘরের টিনের চালা খুলে রেখে স্থানটিকে এমনিই ফেলে রেখেছেন এবং সেখানে কোন লোককে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এ স্থানে নামাজ আদায় করতে না পারায় স্থানীয় জনসাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বিমানবন্দর একটি কেপিআই/ গুরুত্বপূর্ণস্থান হওয়ায় বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ইতোপূর্বে কোন রাজনৈতিক সংবাদ সম্মেলন/ সাৎকার অনুষ্ঠিত না হলেও সম্প্রতি সুপ্লব কুমার ঘোষের অনুমতিক্রমে ভিভিআইপি লাউঞ্জে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। তিনি ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ধরে রাখার জন্য প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং এমপি, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তোষামোদী করে থাকেন। এছাড়া তার অফিস কক্ষে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে আপ্যায়নসহ আলোচনা সভা হয়ে থাকে।
তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও এর সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, দিনাজপুরের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল, নীলফামারীর সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, দিনাজপুরের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোকছেদুল মোমিন প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন।
তিনি ২০২২ সালে রানওয়েতে ড্রাইভিং শেখার সময় নভো এয়ারের একটা বিমান অবতরণকালীন ক্রাশ করতে গিয়েও পাইলটের দক্ষতার কারণে বিমানে থাকা প্রায় ৭০ জন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা পায়। এ ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত শেষে তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তিনি সৈয়দপুর বিমানবন্দরেই বহাল রয়েছেন।
এছাড়াও গত ১৯ অক্টোবর ২০২১ তারিখ ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বদলির আদেশ করা হলেও বিভিন্ন মহলের জোর সুপারিশে তিনি এখনও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে কর্মরত রয়েছেন। সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ২৪০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের টেন্ডার প্রকাশের পর ভাগ বাটোয়ারা ও কমিশন প্রাপ্তির আশায় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিয়ে তিনি স্বপদে বহাল রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।