সাম্প্রদায়িকতা আছে বলেই সম্প্রীতির প্রয়োজন। সময়ের আবর্তে ক্ষয়ে গেছে বিশুদ্ধ সংস্কৃতি। বদল হয়েছে পাঠ্যবই। রাজাকারও মন্ত্রী হয়েছে এদেশে। সুতরাং অল্পদিনে অনেক পরিবর্তনের কারণে র্যাডিকালিজম চাড়া দিয়েছে। সবমিলে একটা অস্থির সময় পার করছে এদেশের জনগন। মনের মধ্যে রাগ ক্ষোভ পুষে না রেখে তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা গঠনে সব মানুষের জোটবদ্ধ হওয়া জরুরী।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সম্প্রীতি বাংলাদেশের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তরা এসব বলেন। মঙ্গলবার এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংগঠনটির কেন্দ্রিয় আহ্বায়ক কমিটি। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের তালিকা নিয়ে এখনও প্রশ্ন করে কেউ কেউ। কারণ এদেশে রাজাকারদের মতো আত্মস্বীকৃত খুনিরা মন্ত্রী হয়েছে। তাদের দোসরেরা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন যদি হয় রক্তের দামে, তাহলে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি স্বাধীনতা কেনে নাই।
বক্তব্যের বিভিন্ন পর্যায়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন স্তরে কিভাবে সাম্প্রদায়িকতা দেখেছেন তার বর্ননা করেন। একইভাবে শিশু কিশোরদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ কিভাবে প্রোত্থিত হতে পারে তারও সরল সমাধান দেন।
নাট্যজন, আবৃত্তিকার ও অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ- কথাসাহিত্যিক ও পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা, একাত্তর টেলিভিশনের নূর সাফা জুলহাজ। চিকিৎসক নেতা ও সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক ডা. উত্তম বড়ুয়া, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ, সময় টেলিভিশনের সম্পাদক মোস্তফা হোসেইন, সম্প্রীতি বংলাদেশের কেন্দ্রিয় নেত্রী জয়শ্রী ব্যানার্জী, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না, গ্রাম থিয়েটারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল উল্লাহ সরকার, একুশে টেলিভিশন এর চিফ নিউজ এডিটর অখিল পোদ্দার, সমাজকর্মী হেলাল উদ্দিন, একুশে টেলিভিশনের ভারপ্রাপ্ত অনুষ্ঠান প্রধান সাইফ আহমেদসহ অন্যরা।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব বিশিষ্ট চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেফাটোলজি বিভাগের পরিচালক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল গোলটেবিল অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
তিনি উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, খুব কৌশলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির মাঝে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। স্কুল থেকে শুরু করে উপর মহলে পৌঁছে গেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষের বাষ্প। এখন প্রশ্ন-আমাদের সেই চিরায়ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাহলে কোথায় গেলো? কিছুদিন আগেও স্কুলগুলোতে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের সঙ্গে গীতা ও ত্রিপিটক পাঠ ছিল। এখন আর ত্রিপিটক কিংবা গীতার বাণী শোনানো হয় না। তাহলে দেশ থেকে কি হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান লুপ্ত হয়ে গেছে? না-কি মন থেকে আমরাই তাদের উপস্থিতিকে অমান্য করতে শিখেছি-এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন উপস্থিত সবার দিকে।
ডিবিসি সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, ১৪২ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ভোট দেয় ৯০ কোটি মানুষ। সেখানকার নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিটি ভোটারের গুরুত্ব অসীম শ্রদ্ধা ও সমমানের। অথচ বাংলাদেশে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সেই সমভাব এখনও অনুপস্থিত। সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়ে ভোট এলেই তাদেরকে আঘাত করা হয়।
সময় টিভির সম্পাদক মোস্তফা হোসেইন বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, বাংলাদেশ মানেই হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি। সেই সোনার বাংলা কোথায় গেলো? ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। প্রাণের ভয়ে দেশান্তরি হচ্ছেন তারা। আমরা মনে করি এটাও এক ধরণের গণহত্যা। কেনো না তরা জীবন বাঁচানোর জন্য এদেশে থেকে লুপ্ত হয়েছেন।
৭২ এর সংবিধান ফেরানোর দাবি জানিয়ে একাত্তর টিভির অনুষ্ঠান প্রধান নূর সাফা জুলহাজ বলেন, এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস বদলে গেছে বিস্ময়করভাবে। সবখানে অতি দ্রুত ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে সাম্প্রদায়িকতা। কী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কী কর্মস্থল, কী চাকরিবাকরি পেতে। এভাবে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না।
অনুষ্ঠানে চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, আমরা আশাবাদী। কোন একদিন আবার ফেলে আসা দিনের সেই সম্প্রীতির বাংলা ফেরত পাবো। এজন্য মন খারাপ করে বসে না থেকে কাজ শুরু করতে হবে সম্মিলিতভাবে।
সংগঠনটির আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সম্প্রীতির অভাবেই সংখ্যালঘুরা বারংবার আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। হয় ভোট, নয়তো জায়গাজমি সংক্রান্ত ঝামেলায়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে। পিরোজপুর থেকে পঞ্চগড়, সিলেট থেকে সাতক্ষীরা অব্দি ছাড়িয়ে গেছে উন্নয়নের শিখা। কিন্তু মানুষের চেতনার উন্নয়ন না ঘটলে এসব একদিন তুচ্ছ বলেই মনে হবে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই প্রতিপাদ্য নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য দেন।
এনএফে/এসএস।