শুক্রবার, ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শূন্যতার রাজনীতি: বাংলাদেশ কি নিজের ভবিষ্যৎ হারাতে বসেছে?

বাংলাদেশ এখন এক বাস্তব রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নিষিদ্ধ করার ফলে রাজনৈতিক কাঠামোতে বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে ব্যাখ্যা করছে, কিন্তু এই অভিযোগের পক্ষে এখনো কোনো স্বচ্ছ তদন্ত প্রতিবেদন বা যাচাইযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিকভাবে গুরুতর বিতর্ক তৈরি করেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও বিষয়টিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তনের সংকেত হিসেবে ব্যাখ্যা করছে।

এই শূন্যতার জায়গায় বিএনপি প্রত্যাশিত বিকল্প হতে পারছে না। জনমত থাকলেও সাংগঠনিক দুর্বলতা, মনোনয়ন নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম, নেতৃত্বের বিভক্তি, এবং নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে দলটি কার্যকর বিরোধী শক্তি হিসেবে মাঠে দাঁড়াতে পারছে না। আন্দোলন-পরবর্তী অস্থির সময়েও বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল অসংগঠিত এবং পরস্পরবিরোধী। তৃণমূল কার্যত নিষ্ক্রিয়, কেন্দ্রীয় কমান্ড দুর্বল—ফলে রাজনৈতিক সুযোগ থাকলেও দলটি তা কাজে লাগাতে পারছে না।

এর ফলে মাঠে জায়গা দখল করছে তৃতীয় এক শক্তি, যাদের পরিচয়, কাঠামো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। এদের মধ্যে অনেকেই নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় উঠে এলেও তাদের সংগঠন এখনো স্থায়ী রাজনৈতিক বলয়ে রূপ নেয়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে এক ধরনের অস্থায়ী রাজনৈতিক উত্থান হিসেবে দেখছেন।

তৃতীয় শক্তির উত্থানের সঙ্গে ধর্মীয় শাসন বা মতাদর্শিক প্রবণতাও আংশিকভাবে উঠে এসেছে, কিন্তু এরা কারা, কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা কতটুকু—এগুলো এখনো অনিশ্চিত। কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, যদিও বাস্তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ক্ষমতাকাঠামো পরিবর্তনের ঘটনা এখনো দেখা যায়নি। কিন্তু রাজনৈতিক শূন্যতা যত বাড়বে, ততই অগোছালো শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের পরিবেশ সৃষ্টি হবে—এটি অস্বীকার করা যায় না।

আঞ্চলিকভাবে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে বিদেশি স্বার্থ এশিয়ার ছোট দেশগুলোকে চাপের মধ্যে ফেলে—এর নজির বহু আছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতার কৌশল, এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ সবসময়ই সংবেদনশীল অবস্থানে থাকে। আন্তর্জাতিক শক্তির সক্রিয় হস্তক্ষেপের সরাসরি প্রমাণ এখনো নেই, তবে ইতিহাস বলছে—রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে বিদেশি প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিক।

মিশরের ঘটনাটি একটি স্পষ্ট উদাহরণ। মুরসির নেতৃত্বাধীন সরকার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতায় এলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল ছিল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অদৃশ্য প্রতিযোগিতা অল্প সময়েই ক্ষমতার সংকট তৈরি করে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিভক্ত ছিল, বিরোধী দল সংগঠিত ছিল না, এবং বিদেশি শক্তিগুলো সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এই ঘটনা দেখায়—যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব অকার্যকর হয় এবং রাষ্ট্র কাঠামো দুর্বল থাকে, তখন গণতান্ত্রিক সরকারের টিকে থাকার সক্ষমতা খুব সীমিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায়ও একই সংকটের উপাদান পাওয়া যায়—বৃহৎ একটি দল নিষ্ক্রিয়, প্রধান বিরোধী দল দুর্বল, নতুন শক্তি সংগঠিত নয়, প্রশাসনিক ভেতরে বিভক্তি বিদ্যমান, আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আস্থা সংকট গভীর হচ্ছে। এসবই রাজনৈতিক অস্থিরতার পূর্বশর্ত।

পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে রাজনৈতিক শূন্যতা আরও বাড়বে। এতে বিদেশি স্বার্থ এবং ভেতরের দালালচক্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। এতে রাষ্ট্র পরিচালনায় অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।

অন্যদিকে নির্বাচন যদি ন্যূনতমভাবে হলেও অংশগ্রহণমূলক হয়, যেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল এবং নতুন শক্তিগুলো প্রতিযোগিতার সুযোগ পায়, তবে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনরুদ্ধার হবে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য স্থায়িত্ব পাবে। রাষ্ট্রে আস্থা ফিরবে। অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে। সার্বভৌমত্বের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন দুই দিকের যেকোনো একটিতে যেতে পারে—
একদিকে রাজনৈতিক শূন্যতার বিস্তার, দুর্বল দলীয় কাঠামো এবং বিদেশি প্রভাবের ঝুঁকি;
অন্যদিকে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর নূন্যতম ঐকমত্য এবং দায়িত্বশীল ক্ষমতার কাঠামো।

এই পর্যায়ে এসে পরিষ্কার যে, কোনো একক দল বাংলাদেশের পথ নির্ধারণ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকুক বা না থাকুক, বিএনপি দুর্বল থাকুক বা না থাকুক—রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ববোধ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধারের ওপর।

বাংলাদেশ কি নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে রাখবে, নাকি রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে নিয়ন্ত্রণ অন্য শক্তির হাতে চলে যাবে—এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ