আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘লকডাউন কর্মসূচি’ ছিল কেবল একটি প্রশাসনিক অনুশীলন নয়, বরং সরকারের সক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার একটি বাস্তব পরীক্ষা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই করেছে। অন্যদিকে, জনগণের অংশগ্রহণ, প্রতিক্রিয়া ও অনুগত্যের মাত্রা থেকেও স্পষ্ট হয়েছে যে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কতটুকু দৃঢ় বা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে।
বৃহত্তর বিরোধী দল বিএনপির জন্য আজকের দিনটি ছিল পর্যবেক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। সরাসরি রাজপথে না থেকেও তারা বুঝে নিতে পেরেছে, দেশের প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা প্রস্তুত, সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাব কত গভীর, এবং জনগণের মনস্তত্ত্বে সরকারের প্রতি ভরসা নাকি ক্ষোভ-কোনটি বেশি প্রবল। একই সঙ্গে, সরকারের ক্ষমতার পেছনে যে অনানুষ্ঠানিক বা অপ্রকাশিত গোষ্ঠীগুলোর বলীয়ান ভূমিকা রয়েছে, তাদের শক্তি-সামর্থ্যও আজ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।
একটি দল, যাকে বহুমুখী অপরাধ ও উগ্রবাদী কার্যকলাপের দায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই দলটির আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক যদি সামান্য উসকানিতেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়, তাহলে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দাঁড়ায়-তারা বিএনপির মতো একটি সাংগঠনিক ও গণভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে কতটা দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবিলা করতে সক্ষম। বিষয়টি নিছক নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং এটি সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার গভীর প্রশ্ন।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ফিডব্যাক হচ্ছে, তারা যেন সংঘাত বা উসকানির রাজনীতি পরিহার করে রাজনৈতিক সমঅধিকার ও গণতান্ত্রিক সুশীলতা বজায় রাখে। কেননা, রাজনীতির মাঠে সমমর্যাদার নীতি রক্ষা না হলে তা শেষ পর্যন্ত চরিত্রহরণ ও বিশ্বাসহানির দিকে গড়ায়। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া বা আবেগতাড়িত রাজনীতি শেষ পর্যন্ত গঠনমূলক শক্তিকে ক্ষয় করে দেয়।
বর্তমান রাজনৈতিক গতিপ্রবাহে বিএনপির প্রতি জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে তারা গণতন্ত্রের পথেই সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। এজন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত বার্তা, জনভিত্তিক সিদ্ধান্ত, এবং যুগোপযোগী কৌশলগত অবস্থান। রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির উচিত সংগঠনগত পুনর্গঠন, তরুণ নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্তি, এবং স্থানীয় পর্যায়ে সক্রিয় জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক ধরনের ‘স্টেট-কন্ট্রোলড ডেমোক্রেসি’–এর ধাঁচে রূপ নিয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার জায়গা সংকুচিত। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য প্রয়োজন একটি সুসংহত রাজনৈতিক রোডম্যাপ-যেখানে থাকবে আন্দোলনের বদলে অংশগ্রহণ, সংঘাতের বদলে সংলাপ, এবং প্রতিপক্ষের বদলে প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল।
সর্বোপরি, আওয়ামী লীগের লকডাউন কৌশল যেমন সরকারের শক্তি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রকাশ করেছে, তেমনি বিএনপির জন্য এটি ছিল আত্মসমালোচনা ও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার এক সতর্ক বার্তা। রাষ্ট্র, সরকার ও বিরোধী দলের এই ত্রিমুখী সম্পর্কেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকনির্দেশনা নির্ভর করবে।
লেখক: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।






