বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার আগে নিজের দেশকে সামলানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজ যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছেন, তারা ২০০১ সাল দেখেননি। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট দেখেননি। আমেরিকাতেও প্রতিদিন গুলি করে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। পরিবারসহ খুন করা হচ্ছে। নিজের দেশের মানুষের বাঁচাবে কী করে তাদের সেই চিন্তা আগে করা উচিত।
বৃহস্পতিবার রাতে একাদশ জাতীয় সংসদের ২৩তম অধিবেশনের (২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন) সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপতির আদেশ পাঠের মধ্য দিয়ে অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণা করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি দেওয়া একটি রেকর্ড করা ভাষণ বাজানো হয়।
২২ কার্যদিবসের এ অধিবেশনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পাস ছাড়াও ১৪টি বিল পাস হয়েছে। বাজেটের ওপর ১৮৭ জন সদস্য ৩২ ঘণ্টা ৩ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য ৯৭টি প্রশ্ন জমা পড়লেও তিনি উত্তর দিয়েছেন ৫৬টির এবং মন্ত্রীদের জন্য ১ হাজার ৮৮৯টি প্রশ্ন জমা পড়লেও তারা উত্তর দিয়েছেন ১ হাজার ৩৩৮টির।
সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির আন্দোলন কেন্দ্র করে হত্যা, অগ্নিসন্ত্রাসসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশে মানবাধিকারের খোঁজে আসে অনেকে। আমার প্রশ্ন, ২০০১-এর নির্বাচনে যখন এভাবে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে, শিশুরা রেহাই পাচ্ছে না তখন সেই মানবাধিকার ফেরিওয়ালারা কোথায় ছিল? তারা কেন চুপ ছিল? তাদের মুখে কোনো কথা ছিল না কেন? সেটা দেশি-বিদেশি, আমি সবার বেলায়ই বলব। আর অনেকেই আসে আমাদের সবক দেয়, মানবাধিকার শেখায়।
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই বলে যারা, তারা ২০০১ দেখেনি? তারা ১৫ আগস্ট দেখিনি? ১৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত কী চলেছে? সেটা তারা দেখেনি, তখন তাদের চোখেও পড়েনি, কানেও শোনেনি?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকারের কথা বলে, আজকে রোহিঙ্গা তাদের দেশে যখন অত্যাচার, নির্যাতিত হচ্ছিল, গণহত্যার শিকার হচ্ছিল, আমরা তাদের আশ্রয় দিই, প্রথম যখন আশ্রয় দিই তখন কে ছিল। আমরা শুধু আশ্রয় নয়, প্রথম কয়েক মাস তো আমরাই খাওয়াই। এই যে তাদের যে পাঁচটা বছর, পরবর্তীকালে তাদের অনেক দেশ অনেক সহযোগিতা করেছে, কিন্তু যখন তারা আমাদের দেশে আসে তখন তো কোনো সাহায্যই আমরা পাইনি। আমরা মানবিক কারণে যখন এতগুলো লোকের দায়িত্ব নিতে পারি, এর থেকে মানবাধিকার সংরক্ষণ আর কী হতে পারে, সেটাই আমার প্রশ্ন।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দেয়, আওয়ামী লীগ সরকার সেই আশ্রয় দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে কেন? কীভাবে করবে? সারা বিশ্বে তো বহু জায়গায় বহু মানুষ খুন হচ্ছে। আমেরিকায় তো প্রতিদিন গুলি করে করে শিশুদের হত্যা করছে স্কুলে গিয়ে, শপিং মলে হত্যা হচ্ছে, রাস্তায় হত্যা হচ্ছে। এমনকি আমাদের বাঙালি মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, ছিনতাই করতে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা ছেলের বাড়ি বেড়াতে গেছে, মসজিদে নামাজ পড়ে ফিরে আসছে, তাকে হত্যা করেছে। আমার আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুল, তাকে হত্যা করেছে। আর প্রতিদিন তো তাদের প্রতিটি স্টেট, এক-একটা স্টেটে দেখা যাচ্ছে, গুলি করে করে মানুষ হত্যা করছে। ঘরের মধ্যে গিয়ে পরিবারসহ হত্যা করে আসছে। তাদের নিজের দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা আগে করা উচিত। তারা নিজের দেশের মানুষ বাঁচাবে কী করে সেই চিন্তা আগে করুক, সেটাই তাদের করা উচিত।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোকে অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। সেখানে কেউ ভোটকেন্দ্র দখলে যায়নি। উপনির্বাচনগুলোও স্বচ্ছ হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কারণ আওয়ামী লীগের আমলে জনগণ ভোট দিতে পারে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে মানুষ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি শান্তিতে আছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। আমরা তা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। একটা মানুষও না খেয়ে মরেনি। বাজারে পর্যাপ্ত খাবার আছে। উৎপাদন বাড়াতে কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছি। গরির-অসহায় মানুষকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছি। মানুষ নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। জনগণের সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ হত্যা নানা ধরনের অপকর্ম করেও তারা কিন্তু এ গণতন্ত্র ধ্বংস করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ আছে বলেই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আওয়ামী লীগ আছে বলেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে। নৌকায় ভোট দেওয়ায় মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ দূর হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত স্মার্ট দেশে পরিণত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রার্থনা করুন, গণতন্ত্র যেন অব্যাহত থাকে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি ধরে রাখতে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতার বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন যাতে দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে। দেশে দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকায় আমরা উন্নয়ন ধরে রেখে দেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছি। গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত না থাকলে এ অর্জন সম্ভব হতো না।’
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজায় সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য ফিতা কেটে নতুন অফিস উদ্বোধনকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
গণতন্ত্রের ধারা যে দীর্ঘ সংগ্রামের ফল তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা এক দিনে আসেনি।
পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখেন।
এর আগে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, মন্ত্রিসভার সদস্য, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপ, সংসদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, নতুন অফিস কাজের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে।
সংসদ লাইব্রেরিটিকে অমূল্য আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী ভালো পার্লামেন্টারিয়ন হওয়ার জন্য অতীতের সংসদ অধিবেশনের কার্যবিবরণী অধ্যয়নে এখানে কিছু সময় ব্যয় করার জন্য আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, তারা কার্যবিবরণীর উদ্ধৃতি দিয়ে সংসদে বক্তব্য দিতে পারেন।
দেশের প্রকৃত ইতিহাস সবাইকে জানাতে সংসদে একটি আর্কাইভ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী স্পিকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই ইসাডোর কানের নকশা করা সংসদের মূল নকশা রক্ষায় তার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার চার লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংসদের সম্পূর্ণ নকশা সংগ্রহ করেছে।
অনুষ্ঠানে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আগামী অক্টোবরের মধ্যে সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, কর্ম ও সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি আর্কাইভ নির্মাণ করা হবে।