বুধবার, ২৬শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ভয়াবহ অবক্ষয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে

বাংলাদেশে শান্তি নেই সবকিছু ভারী হয়ে আছে এক অজানা অনিশ্চয়তায়। দেশের মানুষের চোখে ক্লান্তি ও দীর্ঘশ্বাস আর মনে প্রশ্ন আর কত? দেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সবকিছুকোনোরকম হাঁপাতে থাকা এক আহত শরীরের মতো টলছে।

বাজারে পা রাখলে বোঝা যায় দেশের মানুষ কতটা চাপে আছে। দাম কোনো কিছুরই মানুষের আয়কে মানে না। হাঁটাহাঁটি করা বাবা, বুড়িয়ে যাওয়া মা, কাঁধে সন্তানকে নিয়ে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষ সবাই এমনভাবে হিসাব করছেন যেন এক টাকার হিসাব ভুল হলে আজকের খাবারই হয়তো জুটবে না। সঞ্চয় নেই, চাকরি অনিশ্চিত, কাজের সুযোগ কমে গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে আছে। পরিবারগুলো একরকম আতঙ্কে বেঁচে আছে—এক মাস না এক সপ্তাহ? আগামীকাল কী হবে কেউ জানে না।

তারপর নতুন করে আসলো ভূমিকম্পের ভয়। সকালের আলোয় বিছানায় শুয়ে থাকা শিশুরা হঠাৎ দৌড় শুরু করে, মায়েরা দরজা খুলে চিৎকার করে পরিবারের সদস্যদের ডাকেন, আর পুরুষেরা স্থির থাকতে পারেন না নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবতে ভাবতে। এই দেশটা যেখানে আমরা ভবিষ্যত বানাতে চেয়েছিলাম, সেখানে আজ ভবিষ্যতের ভেবে এই শহরে নতুন করে প্রতিযোগিতার মাঠে স্থির থাকতে নতুন ভাবনায় পরে গেলো।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দোকান আছে, পণ্য আছে, লোক আছে… শুধু ক্রেতা নেই, আস্থা নেই।একজন মা বলেন, সন্তানকে স্কুলে পাঠাই ভয় নিয়ে, রাস্তা পেরোই ভয় নিয়ে, আর খাই ভয় নিয়ে আগামীকাল কী হবে?

আরেকদিকে রয়েছে মামলা, হয়রানি, ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা। দেশের আইন মানুষের রক্ষাকবচ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেকেই এখন বলছেন, আইন যেন তাদের আর নিরাপদ রাখে না। অভিযোগ, প্রতিশোধ, প্রশাসনিক চাপ, অজানা আতঙ্ক সবকিছু মিলিয়ে মানুষ নিজের নিজস্ব ঘরেও আর নিরাপদ বোধ করে না। গ্রামের লোকজন শহরে এসে কাজ খুঁজতে ভয় পাচ্ছেন, শহরের মানুষ আদালত, –থানা –বাজার সব জায়গাই এড়িয়ে চলছেন। কোথাও যেন সেই পুরনো স্বস্তির বাতাস নেই।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। যে রাজনীতি একসময় নীতির কথা বলত, শালীনতার কথা বলত, ভদ্রতার কমপক্ষে নামটুকু রাখত আজ সেই রাজনীতি যেন ময়লার স্তূপে পড়ে আছে। রাজনীতিবিদদের ভাষা মানুষকে আর পথ দেখায় না; বরং মানুষকে ভীত করে, বিব্রত করে, লজ্জায় ফেলে।

টকশো, র‌্যালি, সমাবেশ সব জায়গায় শোনা যায় অবিবেচকের ভাষা, বিদ্বেষের সুর। মানুষ হতবাক হয়ে ভাবছে এরা কি নেতৃত্ব দেবে? নাকি আমাদের বিভক্ত করবে? নাকি বিদেশীদের ফাঁদে পড়ে পুরো ভূখন্ডটি তুলে দিবে; শিশুরা এখন নেতাদের বক্তৃতা দেখে সম্মান শেখে না, শেখে কটু কথা বলার অনুশীলন। তরুণরা রাজনীতিকে ভবিষ্যতের পথ হিসেবে দেখে না; দেখে অস্থিরতা, নোংরামি আর অবজ্ঞার প্রতিযোগিতা। সমাজ ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার নৈতিক শক্তি।

এটা এক নীরব নষ্টের স্রোত যা ছড়িয়ে পড়ছে ঘর থেকে ঘরে, পরিবার থেকে পরিবারে, মানুষ থেকে মানুষের মনে।

এ দেশের জনগণ অনেক বছর ধরে লড়াই করছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তারা ভেবেছিল অন্যায় থামলে, শান্তি আসবে। কিন্তু আজ মানুষ বলছে অন্যায় বাড়লো আগের চেয়ে বেশি, শান্তিও এলো না। তাহলে আমরা কোথায় যাব?

তাদের এই প্রশ্নে রাজনৈতিক রং নেই। এটা সেই মায়ের প্রশ্ন যার সন্তান রাতের বেলা কাঁদে চাপা দুঃশ্চিন্তায়। এটা সেই বৃদ্ধ বাবার প্রশ্ন যার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। এটা সেই তরুণের প্রশ্ন যে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত। এটা সেই ব্যবসায়ীর প্রশ্ন যে প্রতিদিন দোকানের শাটার খুলে ভাবে আজকেও কি কেউ আসবে?

দেশের মানুষ শান্তি চাইছে শুধু শান্তি। যেখানে আইন ন্যায়ের প্রতীক হবে, ক্ষমতার হাতিয়ার নয়। যেখানে রাজনীতি মানুষের ভাষায় কথা বলবে, গালিগালাজে নয়। মানুষ ভয় নিয়ে নয়, স্বপ্ন নিয়ে ঘুমোতে যাবে। পরিবারগুলো বাঁচবে দুশ্চিন্তা ছাড়া।

বাংলাদেশের আজ সবচেয়ে বড় সংকট অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক নয় এটি মানবিক সংকট। মানুষ ক্লান্ত, অবসন্ন, ভীত এবং অনিশ্চয়তায় দগ্ধ। মানুষের বিশ্বাস ফাটলে ভরা। আস্থা শুকিয়ে গেছে নদীর মতো। এখন প্রশ্ন এই দেশ কি শান্তির পথ খুঁজে পাবে? মানুষ কি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারবে? আমরা কি সেই বাংলাদেশে ফিরতে পারব যেখানে পরিবার মানে ছিল নিরাপত্তা, রাজনীতি মানে ছিল শালীনতা, অর্থনীতি মানে ছিল আশা?

দেশের জন্য, মানুষের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন খুব জরুরি। কারণ এটা তো সত্যি, মানুষ সত্যিই ভালো নেই বাংলাদেশে।

হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ