শনিবার, ২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিশ্লেষণ : তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন, দল, নেতৃত্ব ও নির্বাচন কৌশল (দ্বিতীয়)

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান

তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্ব পায়, তা হলো বিএনপি এই প্রত্যাবর্তনকে কীভাবে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারবে। দীর্ঘ সময় ধরে দলটি নেতৃত্ব সংকট, মাঠপর্যায়ের দুর্বলতা এবং আন্দোলননির্ভর রাজনীতির সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে—এমন অভিযোগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন নয়। এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি বিএনপির জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তবে সেই সুযোগ কাজে লাগানো না গেলে প্রত্যাবর্তনটি প্রতীকী ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে পারে।

বিএনপির সাংগঠনিক বাস্তবতা এখন বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জে ভরা। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে দলীয় কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় নেতৃত্বের শূন্যতা, কোথাও আবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল করেছে। তারেক রহমানের একটি ইতিবাচক দিক হলো, তিনি দল পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন এবং অতীতে দলীয় কাঠামো ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন। দেশে ফিরে তিনি যদি জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সাংগঠনিক মূল্যায়ন শুরু করেন এবং দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব পুনর্বিন্যাস করেন, তাহলে তা বিএনপিকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ দিতে পারে।

নেতৃত্বের প্রশ্নে তারেক রহমানের সামনে আরেকটি বড় সুযোগ রয়েছে প্রজন্মগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে। বিএনপির রাজনীতিতে এখনও প্রবীণ নেতৃত্বের প্রভাব প্রবল, যদিও ভোটার কাঠামোতে তরুণদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই বৈপরীত্য দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি বড় দুর্বলতা। তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরেই তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনার কথা বলে আসছেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন যদি বাস্তব অর্থে তরুণ, শিক্ষিত ও পেশাজীবী শ্রেণিকে দলীয় নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে বিএনপি শুধু সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে না, বরং সামাজিক প্রতিনিধিত্বের দিক থেকেও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।

নির্বাচন কৌশল এই পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন মানেই শুধু ভোটের দিন নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। অতীতে বিএনপি কখনো নির্বাচন বর্জন করেছে, কখনো আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যার ফলাফল সবসময় প্রত্যাশিত হয়নি। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর বিএনপির জন্য বড় প্রশ্ন হলো, তারা কি একই পথ অনুসরণ করবে, নাকি একটি নতুন, বাস্তবসম্মত নির্বাচন কৌশল গ্রহণ করবে। তারেক রহমানের ইতিবাচক দিক হলো, তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের একটি অংশ হিসেবে দেখার কথা বলেছেন, কেবল ক্ষমতা দখলের মাধ্যম হিসেবে নয়।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কমিশনের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিয়ে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। তারেক রহমান যদি কমিশনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে নীতিগত চাপ, জনমত গঠন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে সংস্কারের দাবি তোলেন, তাহলে সেটি একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিএনপির অবস্থানও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হবে।

বিএনপির রাজনৈতিক বার্তার ভাষা ও বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দলটি প্রধানত সরকারবিরোধী বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যদিও বিরোধী রাজনীতিতে সরকারের সমালোচনা স্বাভাবিক, তবে কেবল সমালোচনার রাজনীতি জনগণের দীর্ঘমেয়াদি আস্থা অর্জনে যথেষ্ট নয়। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যদি অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে সুস্পষ্ট বিকল্প নীতি তুলে ধরতে পারে, তাহলে তা দলটির রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে।

এখানে ৩১ দফা কর্মসূচির গুরুত্ব আবার সামনে আসে। এই কর্মসূচি বিএনপির নীতিগত অবস্থানের একটি কাঠামো প্রদান করে, তবে বাস্তব রাজনীতিতে এর প্রয়োগ এখনো পরীক্ষিত নয়। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর যদি এই ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে দলীয় প্রশিক্ষণ, জনসংযোগ এবং নীতিনির্ভর আলোচনার সূচনা হয়, তাহলে তা বিএনপিকে স্লোগাননির্ভর রাজনীতি থেকে নীতিনির্ভর রাজনীতির দিকে এগিয়ে নিতে পারে। এতে নির্বাচন কৌশলও আরও পরিপক্ব ও বাস্তবসম্মত হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজনৈতিক সহনশীলতা ও জোট রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একক দলীয় আধিপত্যের ধারণা দীর্ঘদিন ধরে প্রাধান্য পেয়েছে, তবে বাস্তবতা হলো টেকসই গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তারেক রহমান যদি দেশে ফিরে জোট রাজনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, তাহলে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে।

এই দ্বিতীয় পর্বের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য কেবল আবেগঘন মুহূর্ত নয়, বরং একটি কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষা। দল পুনর্গঠন, নেতৃত্বের রূপান্তর এবং নির্বাচন কৌশল—এই তিনটি ক্ষেত্রে তিনি কতটা বাস্তববাদী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তার ওপর নির্ভর করবে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান।

ধারাবাহিক এই বিশ্লেষণের তৃতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপটে ৩১ দফা কর্মসূচি, অর্থনৈতিক নীতি এবং সামাজিক পুনর্গঠন কীভাবে বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপ নিতে পারে।

লেখক: মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ