মঙ্গলবার, ২রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং নিয়ে চিন্তা!

The helicopter shot from Dhaka, Bangladesh with blue sky

স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্তত তিনটি বোয়িং এয়ারক্রাফটে নানা ধরণের ত্রুটির কারণে যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে। কখনো মাঝ আকাশে থাকতে উইন্ড-শিল্ড (ককপিটের জানালার কাঁচ) ফেটে যাওয়ায় জরুরী অবতরণ করতে হয়েছে। আবার একটি ক্ষেত্রে উড্ডয়নের আগ মুহূর্তে দরজা ঠিক মতো বন্ধ না হবার ত্রুটি ধরা পড়েছে।

এসব ঘটনা দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাগুলো এমন এক সময়ে ঘটলো যখন বিশ্বজুড়ে এয়ারক্র্যাফট নির্মাতা সংস্থা বোয়িং বিমানের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে তোলপাড় চলছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বহরে থাকা ২১ টি উড়োজাহাজের ১৬টি বোয়িং-এর।

প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘটনায় কি চিন্তিত হবার মতো কোন কারণ আছে? সম্প্রতি বোয়িং-এর ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে তোলপাড় চলছে সেটির সাথে এসব ঘটনা মেলানোর কোন সুযোগ আছে কি?

সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ

গত ২৬শে জুন বিমানের একটি ফ্লাইট হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের জন্য রানওয়েতে ওঠার পর পাইলট দুটি দরজা আনলকড্ দেখতে পান বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।

পরে হ্যাঙ্গারে (বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ রাখার স্থান) ফিরিয়ে নেয়া হয় উড়োযানটিকে। ত্রুটি ঠিক করে পুনরায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কাতারের দোহা রুটে রওনা দেয় সেটি। উড়োজাহাজটির মডেল ছিল বোয়িং ৭৩৭-৮০০।

এর আগের দিন চট্টগ্রাম থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির উদ্দেশে যাত্রা করে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ করে একটি ফ্লাইট।

উইন্ড-শিল্ডে ফাটল দেখা দেয়ার পর জরুরি অবতরণ করে এটি। বিমানের জনসংযোগ কর্মকর্তা বোসরা ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই এয়ারক্র্যাফটটিও বোয়িং এর।

গত ১৪ মে ভোর ৪ টার দিকে ঢাকা থেকে টরন্টোর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট। এই বিমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যাত্রা বিরতি করে পুনরায় জ্বালানি নিয়ে টরন্টোর উদ্দেশে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের লখনৌর আকাশে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে পাইলট দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি এভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

এর আগে ২১ জানুয়ারি উইন্ড-শিল্ডে ফাটল দেখা দেওয়ায় সৌদি আরবের দাম্মাম অভিমুখে উড়াল দেয়া একটি ফ্লাইটকেও ফিরে আসতে হয় ঢাকায়।

উড্ডয়নের দুই ঘন্টা পর সেটি শাহজালাল বিমানবন্দরে ফিরে আসে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন বিমানের জনসংযোগ শাখার তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার।

দুশ্চিন্তার কারণ আছে?

এভিয়েশন বিষয়ে পর্যবেক্ষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, বোয়িং বিমানের উইন্ড-শিল্ডে ফাটলের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয়, গত কিছুদিনে আরো কয়েক জায়গায় বোয়িং বিমানে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে, দরজার লক সংক্রান্ত ত্রুটিও ছিল। তবে, সেগুলো যথাসময়ে পাইলটের নজরে আসে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে কোনো বিপত্তি ঘটেনি।

বাংলাদেশের একজন বিমান দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব.) সালাউদ্দিন রহমতুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এসব ত্রুটিতে বিপদের ঝুঁকি খুব একটা বেশি নয়। যাত্রীবাহী বিমানে ঘন ঘন এ ধরণের ঘটনা কাম্য নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিমান তৈরির সময় ‘ত্রুটি’ কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে ‘দুর্বলতার’ কারণে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

এভিয়েশন খাত পর্যবেক্ষক কাজী ওয়াহেদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, এয়ারক্রাফট ডিজাইনিং বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে কোন ত্রুটি থাকলে সেটা ১০ বছর পরেও বেরিয়ে আসতে পারে।

“আরো কয়েকটি দেশে একই রকম ঘটনা যেহেতু ঘটেছে, এটি ম্যানুফাকচারিং ত্রুটির কারণেও হতে পারে।” এর পাশাপাশি মেইনটেন্যান্সের ঘাটতিও কারণ হতে পারে, বলেন তিনি।

মি. ইসলাম বলেন, “মেইনটেন্যান্সের সঙ্গে জড়িত ইঞ্জিনিয়াররা আরেকটু সতর্ক হয়ে কাজ করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে।”

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর জনসংযোগ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১২০ দিন পরপর এয়ার ক্র্যাফটগুলোর মেইনটেন্যান্স করা হয়। সর্বশেষ মেইনটেন্যান্স-এর পর ১২০ দিন পার হওয়ার আগেই এবার উইন্ড-শিল্ডে ফাটলের ঘটনাটি ঘটেছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ বিমানের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা ২১ টি। এর মধ্যে বোয়িং এর তিন মডেলের ১৬ টি ‘ফ্লিট’ রয়েছে।

বোয়িং ৭৩৭ সিরিজের ৮০০ মডেলের ছয়টি, ৭৭৭ সিরিজের ৩০০ – ই আর চারটি এবং ৭৮৭ সিরিজের ছয়টি এয়ারক্র্যাফট আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হাতে।

এসব বিমানের কয়েকটি ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, বোয়িং এর সবচেয়ে বিতর্কিত মডেল ৭৩৭ ম্যাক্সের কোনো উড়োজাহাজ বহরে না থাকায় দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে দাবি করছেন বিমানের জনসংযোগ কর্মকর্তা বোসরা ইসলাম।

“বোয়িং এর সঙ্গে পরামর্শ করেই আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা খতিয়ে দেখছেন। মেইনটেন্যান্সের কাজও তাদের পরামর্শেই করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

বিমান দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব.) সালাউদ্দিন রহমতুল্লাহ অবশ্য, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পেছনে নির্মাণ ত্রুটির চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের উদাসীনতার সম্ভাবনাই বেশি দেখেন।

“প্রাইভেট এয়ারলাইন্স অনেক নজরদারিতে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিমানের কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার ঘাটতি দেখা যায়। যে কারণে হয়তো মেইনটেন্যান্সটা ঠিক মতো হয় না,” যোগ করেন তিনি।

বিমানের উইন্ডশিল্ডে একাধিক স্তরের কাঁচ থাকে।

মি. রহমতুল্লাহ বলেন, সাধারণত সবগুলো স্তর একসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কোনো স্তরে ফাটল দেখা দিলেই পাইলট গতি কমিয়ে অবতরণের প্রস্তুতি নিতে পারেন। ফলে, কাঁচ ফেটে যাওয়া থেকে বড় বিপদের শংকা সচরাচর থাকে না।

কিন্তু, দেশে না হয়েও বিদেশের কোনো বন্দরে অবতরণ করতে হলে আর্থিক ক্ষতিও কম নয়, উল্লেখ করেন তিনি।

২০২২ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে পরে অবতরণের পর বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং ৭৩৭এর উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখতে পান পাইলট।

পরে মেরামতের জন্য প্রকৌশলী ও যন্ত্রপাতি পাঠানোর আগ পর্যন্ত কয়েকদিন উড়োজাহাজটিকে কুয়ালালামপুরেই ফেলে রাখতে হয়।

তবে, বিমানের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।

বিবিসি বাংলাকে বোসরা ইসলাম বলেন, “মাত্র ২১টা এয়ারক্রাফট। কিন্তু, ফ্লাই করে অনেক বেশি। মাত্রই হজ্জের মৌসুম গেলো।”

“যে পরিমাণ আমাদের ক্যাপাসিটি তার বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি,” যোগ করেন তিনি।

বিমানের বহরে বোয়িং এর সবচেয়ে বিতর্কিত ৭৩৭ ম্যাক্স না থাকায়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলে, মন্তব্য করেন মিজ ইসলাম।

কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, ৭৮৭ সিরিজের বিমানগুলোর নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঠিকমতো যাচাই করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান কর্তৃপক্ষ তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে।

বোয়িং বিতর্ক

কয়েক বছর আগে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে পরপর দুটি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৩৪৬ জনের মৃত্যু প্রথম বড় ধাক্কা দেয় বোয়িংয়ের খ্যাতিতে।

বিমান দুটি ছিল ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের।

এ বছরের ছয়ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে একটি বোয়িং বিমানের দরজা খুলে পড়ে যায়। আলাস্কা এয়ার লাইন্সের এয়ারক্র্যাফটটির মডেল ছিল ৭৩৭ ম্যাক্স নাইন।

আগে থেকেই বোয়িং যানগুলোর নিরাপত্তা ও অন্যান্য ত্রুটি নিয়ে কথা বলে আসছিলেন কোম্পানিটির প্রাক্তন কর্মীদের কেউ কেউ।

সাবেক কোয়ালিটি কন্ট্রােল ম্যানেজার জন বারনেট ২০১৯ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ক্রেতার কাছে দ্রুত সরবরাহ করতে গিয়ে মান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

এরপর আরো কয়েকজন “হুইসেল ব্লোয়ার” একই রকম অভিযোগ তোলেন।

যদিও বোয়িং এর বিমান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তরফে সেসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

এর মধ্যে বিমানের চাকা খুলে পড়ে যাওয়া, প্যানেল খোয়া যাওয়ার মতো ঘটনা বিতর্ক আরো উসকে দেয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ