১০ জানুয়ারি,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২সালের এই দিনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করার পরই পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তাঁকে পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭ টার বিবিসি’র সংবাদে বলা হয়,বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন।তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে।বঙ্গবন্ধু প্লেন থেকে নামার পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা তাঁকে স্বাগত জানান এবং রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদার সিন্ধান্তের কথা বলেন। ব্রিটিশ সরকারের সন্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন।বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছানোর খবর শুনে তিনি পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ১০ নং ডাইনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।এবং গাড়ীর গ্লাস খুলে বঙ্গবন্ধু বের না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,এমন নজিরবিহীন সম্মান বিট্রিশ কোনো প্রধানমন্ত্রী আগে কিংবা পরে কোনো নেতা কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে দেননি।
১০ তারিখ ভোর থেকেই ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিনত হয়েছিল। প্রিয় নেতাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিল রমনার রেসকোর্স ময়দান থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর পর্যন্ত। জনতার স্রোতে মাত্র চার কিলোমিটার রাস্তা যেতে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী মোটর শোভাযাত্রার দুই ঘন্টারও বেশি সময় লেগেছিল। শুধুমাত্র ঢাকা শহরই নয়,চার পাশের জেলা গুলো থেকেও হাজার হাজার জনতার উপস্থিতি সত্যিকার অর্থেই উৎসবের নগরীতে পরিনত হয়েছিল। প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান।হাতে ছিল জাতীয় পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি।বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা।তাঁরাই বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে চলে আসেন। ৭ মার্চ যে ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন,‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ‘দেশে ফিরে সেই রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়েই আগামী বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করলেন।দশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে প্রায় ১৭ মিনিট বক্তব্য রাখেন।সেখানে তিনি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন।বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কি হবে,রাষ্ট্র কাঠামো কি হবে,মুক্তিবাহিনী,ছাত্রসমাজ,কৃষক,শ্রমিকদের কি কাজ হবে,যারা দেশদ্রোহী হয়ে পাকিস্তানিদের দালালী করেছে তাদের কি হবে এসব বিষয় সহ দেশ পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা দেন। তিনি জনগণকে দেশ গড়ার সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে তাদের সমর্থন চান,উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা দু’হাত তুলে সমর্থনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
যাদের প্রাণ ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র,শ্রমিক,কৃষক,বুদ্ধিজীবী,সিপাই,পুলিশ,জনগনকে।তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে,তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের দুই একটা কথা বলতে চাই।’তিনি বলেন,‘আজ থেকে আমার অনুরোধ,আজ থেকে আমার আদেশ,আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে,নেতা হিসেবে নয়,প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়,প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়,আমি তোমাদের ভাই,তোমরা আমার ভাই,এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে খেতে না পায়।এই স্বাধীনতা আমাদের পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়,এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
দেশের উন্নয়নে জনগণকে আহবান জানিয়ে বলেন,‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন,আমি সমস্ত জনগনকে চাই,যেখানে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে,নিজেরা রাস্তা তৈরি শুরু করে দাও।আমি চাই জমিতে যাও,ধান বোনাও।’সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন,‘কর্মচারিদের বলে দেবার চাই,একজনও ঘুষ খাবেন না,আমি ক্ষমা করব না।’
ভাষণের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করে বলেন,‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম।বলেছিলাম,আমি বাঙালি,আমি মানুষ,আমি মুসলমান,একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম,আমার মৃত্যু যদি এসে থাকে আমি হাসতে হাসতে যাব।আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না।তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব,জয় বাংলা,স্বাধীন বাংলা,বাঙালি আমার জাতি,বাংলা আমার ভাষা,বাংলার মাটি আমার স্থান।’
রাষ্ট্রের ভিত্তি কি হবে,সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেন,‘এই বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা,এই বাংলাদেশ হবে গনতন্ত্র,এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ ’৭২-এর সংবিধানেইবঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাই।জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার ভিত্তির উপর বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়ণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে সংবিধান পাশ হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র,গনতন্ত্র,জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন,তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে,শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।’
যারা দেশদ্রোহী হয়ে পাকিস্তানের দালালি করে যারা দেশের ক্ষতি করেছে তাদের বিচারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘যারা দালালি করেছে,যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে তাদের বিচার এবং শাস্তি হবে।তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন,একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে,শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’
পাকিস্তানের সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে,সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো।তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে,আমার মা-বোনদের রেপ করেছে,৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে,যাও সুখে থাকো। তোমরা স্বাধীন থাকো,আমিও স্বাধীন থাকি।’
বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত ভাষণটি অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কোচিত ছিল। ভাষণে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেন। যা পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য ভুমিকা পালন করে।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন হলেও ১০ জানুয়ারি পরিপূর্ণ ভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতার আনন্দ ছিল না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে ফিরে আসার পরই পরিপূর্ণতা পেয়েছিল বিজয়ের আনন্দ।
লেখকঃসাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল-haldertapas80@gmail.com