গত ৫ আাগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে নতুন করে সংবিধান সংস্কারের দাবি ওঠে। নানা মহলের দাবির প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধনে সংস্কার কমিশনও গঠন করে। এরপরই নানা মহল থেকে ভিন্ন ভিন্ন মতামত উঠে আসতে শুরু করে। অনেকে বলেন, সংবিধান পুনর্লিখন করতে আবার অনেকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন না করে তা সংস্কারের দাবি জানান।
আজ শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ (বিআইপিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক সংস্কার’ শীর্ষক এক পরামর্শমূলক সেমিনারে বক্তরা বলেছেন, পুনর্লিখন নয়, সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হবে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভার ক্ষমতার পৃথক্করণ করতে হবে।
সেমিনারে উপস্থিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী, সংবাদপত্রের সম্পাদক, আইনের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল এবার যাতে বেহাত না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে পরামর্শমূলক ওই সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে যে নামেই ডাকেন, এটি একটি সফল আন্দোলন। যে কারণে মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা স্বৈরশাসককে দেশ থেকে পালাতে হলো। এই যে সরানো হলো, এটি হলো সাংবিধানিক অধিকার। সব অধিকার লেখা থাকে না।
শাসনতন্ত্রের সংস্কার নিয়ে বিচারপতি মতিন বলেন, পুনর্লিখন বলেন, যা-ই বলেন, এটির অধিকার কার? অধিকার তাদেরই, যারা এই পরিবর্তন (সরকার পরিবর্তন) এনেছেন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয় জানিয়ে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, পাঁচ বছর পর হলেও গণতন্ত্রের একটু স্বাদ পেতাম। (আগে) নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। একটি ব্যবস্থা করা গেল ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দু-তিনটি নির্বাচন ভালোই করলাম। পরে সেটি আবার বেহাত হয়ে গেল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও অপপ্রয়োগ (অ্যাবিউজ) হয়েছে উল্লেখ করে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, এটিকে মেরামত করা যেত। কিন্তু এটিকে এমনভাবে বাধাগ্রস্ত (ব্যারিয়ার) করা হলো, নির্বাচন বলতে কিছুই থাকল না। ২০১৪ সালে একটি নির্বাচন হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। এরপর ২০১৮ সালে দেখা গেল রাতের বেলায় ভোট হয়ে গেল। আর ২০২৪ সালে দেখা গেল ‘ডামি নির্বাচন’। ত্রয়োদশ সংশোধনী যদি থাকত, অন্তত মন্দের ভালো একটি নির্বাচন হতে পারত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, যারা ক্ষমতায় যায়, তাদের নির্বাচনের প্রতি একটি ভয় যে নির্বাচন করা মানে চলে যাওয়া।
সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে বিচারপতি মতিন বলেন, ইতিমধ্যে যেগুলো স্বীকৃত বা মীমাংসিত বিষয়, এগুলোতে মনে হয় হাত দেয়া ঠিক হবে না। যেমন ‘রিপাবলিক’। এগুলো বিদ্যমান রেখে এখান থেকে আরম্ভ করতে হবে। সেটির সংস্কারের করার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে মেরামত করা, এগুলোতে হাত দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মো. দস্তগীর হোসাইন বলেন, এত সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন হলো, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। পরবর্তী সময়ে কী পেলাম? ফল শূন্য।
ছাত্র-জনতা এগিয়ে না এলে আমরা যে গর্তে ছিলাম, সেখানেই পড়ে থাকতাম মন্তব্য করে বিচারপতি সৈয়দ দস্তগীর হোসেন বলেন, আমরা একজনের কথায় উঠা বসা করতাম। সোনার বাংলাকে তামা বানায় দিয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে বলবো সংস্কার কমিটি আর বাড়ায়েন না, সবাই একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন। কমিটি করে কিছু হবে না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে নতুন সুযোগ এসেছে উল্লেখ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, একটি বক্তব্য এসেছে, আমরা কি নতুনভাবে সংবিধান লিখব, নাকি আগেরটি সংশোধন করব। আমার মত হচ্ছে আগেরটার সংশোধন করাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, আগেরটির মধ্যে অনেক মূল্যবান বক্তব্য আছে। ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি আছে। এটিকে আরও গণতান্ত্রিক করা, আরও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের সরকার না আসে, যারা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। এ জন্য সংশোধন দরকার।
সংবিধান সংশোধনে কী কী করা যেতে পারে, সে বিষয়েও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন মাহ্ফুজ আনাম। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণের (সেপারেশন অব পাওয়ার) ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে খর্ব হয়েছিল। আইন বিভাগ স্বাধীন দায়িত্ব পালন করেনি। সেটি ক্ষমতাসীন দলের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে কাজ করেছে। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল নির্বাহী বিভাগের কাছে। সেটির পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে।
মাহ্ফুজ আনাম আরও বলেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা, সর্বোপরি সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, সেটি নির্ধারণ করে বিচার বিভাগ। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দরকার। গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেটি দরকার। নতুন নতুন আইন করে গণমাধ্যমকে কুক্ষিগত করা হয়েছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরে সেটির পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন বলতে গেলে গণমাধ্যমকে হত্যা করার প্রয়াস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মনে করেন মাহ্ফুজ আনাম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, বর্তমানে যারা সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান লিখতে চাচ্ছেন, তা তাদের এখতিয়ারে নেই। তবে সংবিধান সংশোধন হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পরামর্শ সভায় আরও বক্তব্য দেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের সভাপতি সি এ এফ দৌলা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী উত্তম কুমার দাস, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ।