বৃহস্পতিবার, ১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পিআর পদ্ধতি: দোলাচলে জাতীয় নির্বাচন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন যে বিতর্কটি জোরালো হয়ে উঠেছে, সেটি হলো প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন। ‘পিআর নির্বাচন’ বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বলা হয়। এ ধারণা মোটেও নতুন নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এটি হঠাৎ করে যেভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে বিষয়টি কেবল নির্বাচন সংস্কারের প্রস্তাব নয়, বরং রাজনৈতিক অপকৌশলের অংশ। বিশেষত বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দলের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, ‘পিআর’ এখন ভোটের পদ্ধতির আলোচনা ছাড়িয়ে ক্ষমতায় স্থান করে নেবার এক নতুন কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিএনপির অবস্থান এই বিষয়ে পরিষ্কার। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “বাংলাদেশে পিআর মানে বিভ্রান্তি ছড়ানো।” তাঁর মতে, দেশের সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থার অর্থ ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানে না, অথচ কিছু মহল পরিকল্পিতভাবে এটি সামনে এনে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে জটিল করতে চাইছে। তাঁর ভাষায়, “এটা নতুন এক ধরণের প্যাঁচ, যাতে নির্বাচনের সময়সূচি ও কাঠামো নিয়ে আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।” দলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই বিতর্কের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নিজেদের মতো সাজানো।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও একই কথা বলেছেন—“এই পিআর নিয়ে কথা বলে জনগণকে ভুল পথে নেওয়া হচ্ছে।” তাঁর দাবি, এটি আসলে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরির নতুন প্রচারণা। যখন দেশে ভোটের পরিবেশ গড়ে তোলার কথা, তখন এ ধরনের প্রস্তাব নির্বাচনকে আরও জটিল করছে। বিএনপির অন্যান্য নেতারাও একে ‘বিলম্বের কৌশল’ হিসেবে দেখছেন। কারণ, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হলে সাংবিধানিক সংশোধন, আইনি কাঠামো, প্রশাসনিক প্রস্তুতি-সবকিছুতে সময় ও রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে কথা বলছে। তাদের দাবি, এই ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি হবে, ফলে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য আসবে। কিন্তু বিএনপি ও অনেক বিশ্লেষকের মতে, জামায়াতের এই অবস্থান আসলে নিজেদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা। যেহেতু এখনও জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াত ক্ষমতা এবং সংসদীয় আসন বন্টনের কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছে, তাই পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে তালিকা-ভিত্তিক সংসদ সদস্য নির্বাচনের সুযোগ তাদের জন্য বড় সুবিধা তৈরি করতে পারে। বিএনপির যুক্তি হলো, এটি বৃহত্তর গণতন্ত্রের স্বার্থে নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য ‘রাজনৈতিক শর্টকাট’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই সময়ে হঠাৎ পিআর নিয়ে এমন বিতর্ক শুরু হলো? ২০২৪ সালের পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন পুনর্গঠনের পর্যায়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কবে, কীভাবে এবং কোন কাঠামোতে হবে-তা এখনো অনির্দিষ্ট। এই অনিশ্চয়তার সুযোগে বিভিন্ন প্রস্তাব আসছে, যার একটি হলো পিআর পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে ভোটাররা এখনো সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পদ্ধতিতেই অভ্যস্ত। তালিকা-ভিত্তিক নির্বাচন বা দলীয় তালিকার ভোটের ধারণা তাদের কাছে জটিল ও দুর্বোধ্য। এই দুর্বোধ্যতাই এখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে।

পিআর পদ্ধতির মূল ধারণা হলো, মোট ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদে আসন বণ্টন করা, যাতে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। তত্ত্বগতভাবে এটি একটি ন্যায্য ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, যেখানে দলীয় গণতন্ত্র দুর্বল এবং মনোনয়ন নির্ভর করে নেতৃত্বের ইচ্ছার ওপর, সেখানে এই পদ্ধতি কার্যত ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করবে। দলের প্রধানরা তালিকা তৈরি করবেন, এবং সেই তালিকা থেকেই সংসদ সদস্য হবেন। এতে সাধারণ ভোটারের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়বে। মির্জা ফখরুলের ভাষায়, “এটা গণতন্ত্র নয়, বরং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোনয়ন রাজনীতি।”

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ইতিমধ্যে নির্বাচন সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। কেউ কেউ ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রচলিত ব্যবস্থা অথবা পিআর পদ্ধতিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। বর্তমানে দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস এতটাই গভীর যে, কোনো প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনই এখন গণসমর্থন পাবে না।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে, এখনই পিআর পদ্ধতিতে যাওয়ার বাস্তবতা নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি জানিয়েছেন, “আরপিওতে পিআর নেই, আরপিও সামনে রেখেই কমিশনকে এগোতে হচ্ছে।” অর্থাৎ সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (FPTP) পদ্ধতিতেই ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এই বক্তব্যে জামায়াতের ক্ষোভ দেখা গেছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা একটা দলের মতো কথা কেন বলবেন?” তিনি দাবি করেছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তাহলে “এক মাসের মধ্যেই পিআর বাস্তবায়ন করা সম্ভব।”

তবে বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলি স্পষ্টভাবে বলেছেন, পিআর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে, তারপর তার ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন, বিধিমালা তৈরি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, এবং “বছর দেড়েকের আগে শেষ করা সম্ভব নয়।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ বহু বছর ধরে সরাসরি ভোট দিতে অভ্যস্ত। এখন যদি পিআর চালু করতে হয়, তাহলে ভোটারদের নতুনভাবে বোঝাতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সচেতনতা কর্মসূচি চালাতে হবে।” তাঁর মতে, ফেব্রুয়ারির মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট-যেখানে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী জয়ী হন। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কিছু দেশ আনুপাতিক ব্যবস্থায় গিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও দলনির্ভর রাষ্ট্রে এই পদ্ধতি কার্যকর করার আগে বিশাল প্রস্তুতি ও গণসংলাপ দরকার। এখনো সেই প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক দল নিজেদের অবস্থান পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতের মতো দলগুলো আনুপাতিক ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলছে, কারণ এতে ছোট দলের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়ে। কিন্তু বিএনপি এখনো প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতেই বিশ্বাসী। এই অবস্থানগত বিভাজনের ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তাই এখন যে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে, তাতে, পিআর নির্বাচন নিয়ে যত কথা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ‘পিআর রাজনীতি’। এটি যেন রাজনৈতিক প্রচারণার এক নতুন ক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি দল নিজেদের স্বার্থমাফিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে। কেউ বলছে এটি গণতন্ত্রের বিকল্প, কেউ বলছে এটি গণতন্ত্রের বিকৃতি। কিন্তু জনগণ-যাদের হাতে ক্ষমতা থাকার কথা-তারা এখনো এই আলোচনার বাইরে।

সবশেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই আলোচনার উদ্দেশ্য কি সত্যিই নির্বাচন সংস্কার, নাকি এটি কেবল আরেকটি রাজনৈতিক চাল? সংবিধান পরিবর্তন ছাড়াই পিআর চালু করা সম্ভব নয়, এবং ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে পিআর বিতর্ক কার্যত সময়ক্ষেপণের একটি উপায় হয়ে উঠছে, যা নির্বাচনের প্রস্তুতিকে অনিশ্চিত করছে।

পিআর পদ্ধতি তাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক বিকল্প হতে পারে-যদি তা জনগণের মতামতের ভিত্তিতে, স্বচ্ছ আইনি কাঠামো ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যদি এটি ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের হাতিয়ার হয়, তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনবে। এখন প্রয়োজন, এই পিআর প্যাঁচ থেকে নির্বাচনকে মুক্ত রাখা, যেন ভোট হয় জনগণের হাতে-তালিকার হাতে নয়।

লেখক : রাজু আলীম কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ