বাংলাদেশের ভোটসংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বিশেষ করে তার সেই মন্তব্য, “মার্কা দেখে ভোট দিতে দিতে আমরা নাকি স্বৈরাচারী নেতার পথ তৈরিই করে দিচ্ছি।” এই আক্ষেপে এক ধরনের সত্য যেমন আছে, তেমনি আছে মৌলিক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার ঝুঁকিও। কারণ রাজনৈতিক দল, প্রতীক এবং গণতন্ত্র-এই তিনটিকে আলাদা করে দেখা যায় না; কোনো একটিকে সরিয়ে ফেললেই বাকি দু’টির অস্তিত্ব সংকুচিত হয়ে পড়ে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দল হলো সংগঠিত রাজনৈতিক চেতনার বাহন। একজন প্রার্থী যখন ভোটে দাঁড়ান, তিনি কেবল নিজের প্রতিনিধিত্ব করেন না; তিনি একটি মতাদর্শ, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বহন করেন। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই যেখানে দলকে অস্বীকার করে কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচনের ওপর নির্ভর করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত না করলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় দাঁড়ানোর জায়গাটাই থাকে না। ভারত, যুক্তরাজ্য, জাপান-সব দেশেই ভোট মূলত দলকেই দেওয়া হয়, ব্যক্তিকে নয়। তাহলে বাংলাদেশে সেই একই বাস্তবতাকে হঠাৎ করে নেতিবাচক বলে চিহ্নিত করার মধ্যেই কি সত্যিকারের সমস্যা লুকিয়ে নেই?
অভিযোগ থাকে-“মার্কা দেখে ভোট দিলে মানুষ ভাবনার স্বাধীনতা হারায়।” কিন্তু আসল প্রশ্নটা অন্যখানে। মার্কা কি স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, নাকি দলীয় কাঠামোর ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব মানুষকে সীমাবদ্ধ করে? যেখানে নমিনেশনের তালিকা ‘ওহি নাজিল’ হয়ে আসে, যেখানে দলীয় পরামর্শ, নেতৃত্ব বাছাই, প্রার্থী নির্ধারণ-সবকিছু হয় অল্প কয়েকজনের ইচ্ছায়, সেখানে ভোটার যত সচেতনই হোন, প্রতীকটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো শক্তিশালী ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা ঠেলে দেয়। তাই সমস্যার মূল মার্কায় নয়-বরং সেই দলীয় গণতন্ত্রের অভাবে, যে অভাব প্রতীককে একসময় প্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার প্রতীক বানিয়ে ফেলে।
দলের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকলে প্রতীক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে না; বরং ব্যক্তিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। কিন্তু এ কারণে প্রতীক বহনকারী দলকে বা প্রতীক ব্যবস্থাকেই বাতিল করা গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী। গণতন্ত্রের পাঠ বরং বলে-ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ। ব্যক্তি ভুল করতে পারে, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে; কিন্তু দলের কাঠামো, নীতি আর সংগঠনের জবাবদিহি তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রতীক সেই নীতি ও কাঠামোর পরিচয়। একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে গেলে জনগণ তাঁর অতীত, তাঁর মূল্যবোধ, তাঁর যোগ্যতা সবসময় জানেন না; কিন্তু তাঁর দলকে, তার রাজনৈতিক ধরনকে, তার ইস্তেহারকে জানেন। তাই প্রতীক অস্বীকার করা মানে সেই জ্ঞানকেই অস্বীকার করা।
সমালোচকেরা প্রায়ই বলেন-“যে এত সমালোচনা করে, সে নিজে দাঁড়াক, দেখা যাক কয় ভোট পায়!” ইঙ্গিতটা কৌতুকপূর্ণ হলেও সত্য বড়ই কঠিন। কারণ রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তির পক্ষে জনগণের আস্থা অর্জন করা বিশ্বের যে কোনো গণতন্ত্রেই প্রায় অসম্ভব। গণতন্ত্র দলনির্ভর; ব্যক্তিনির্ভর নয়। রাজনীতি মাঠে তৈরি হয়, সংগঠনে টিকে থাকে, দলের আদর্শে গড়ে ওঠে—কাগজের সমালোচনায় নয়।
এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে প্রতিটি নির্বাচনে দলগুলো যে ইস্তেহার ঘোষণা করে, তার বাস্তবায়নও সম্ভব হয় কেবল দলের মাধ্যমে। প্রতীক না থাকলে ইস্তেহারের মালিক কে? নীতি বাস্তবায়নে দায় নেবে কে? মার্কা বাদ দিলে ভোটারের সামনে যে অবস্থা দাঁড়াবে তা হলো-ব্যক্তিবাদী রাজনীতি, দায়িত্বহীন প্রতিশ্রুতি, আর জবাবদিহি-শূন্য নেতৃত্ব। গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় বিপদ এখানেই।
অতএব, আলোচনার কেন্দ্রে প্রতীক নয়, থাকা উচিত দলীয় কাঠামোর ভিতরের গণতন্ত্র—প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতা, নেতৃত্বে জবাবদিহি, ভিন্নমতের স্থান, এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার স্বাধীনতা। মার্কা গণতন্ত্রের শত্রু নয়; বরং গণতন্ত্রকে তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয়। এটা বাদ দিলে গণতন্ত্র আরও দুর্বলই হবে।
স্বাধীনতার চাবিকাঠি প্রতীক নয়, বরং প্রতীকের সঠিক ব্যবহার; ক্ষমতার উৎস দল নয়, বরং দলীয় গণতন্ত্র। দেশকে সামনে নিতে হলে দলকে শক্তিশালী করতে হবে, দলকে নয়–ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রাজনীতি গড়ার ধারা ভাঙতে হবে। গণতন্ত্রের প্রকৃত পাঠ সেখানেই।
লেখক : মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।








