সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনৈক শিক্ষিকাকে ঘিরে নানা আলোচনা, মন্তব্য ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি অনলাইনে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে এবং নেটিজেনদের মধ্যে নানা মতবিভেদ দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটি সত্য; আবার কেউ মনে করছেন, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি প্রচারণা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই আলোচনার কোনো যাচাইকৃত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
একটি ভিডিও বা স্ট্যাটাস থেকেই কেমন করে একটি মানুষকে ঘিরে তৈরি হয় বিতর্ক, সেটিই এখন আলোচনার বিষয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার কোনো নাম বা ছবি ছড়িয়ে পড়লে সেটি ফিরে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। একজন মিডিয়া বিশ্লেষক বলেন, আমরা এমন এক সময় পার করছি যেখানে সত্য যাচাইয়ের চেয়ে দ্রুত শেয়ার করাটাই যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এমন কাজ অনেক সময় একজন মানুষের মানহানি ও ব্যক্তিগত জীবনে গভীর আঘাত হানে।
বাংলাদেশের সাইবার আইনে গুজব বা মিথ্যা তথ্য প্রচার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার ও সচেতনতা এখনো সীমিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের বিষয়ে মন্তব্য করছে অবলীলায়, অনেক সময় বিনোদনের উদ্দেশ্যে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাজের আলোকবর্তিকা, তাদের নিয়ে যাচাইহীন মন্তব্য শুধু ব্যক্তিকেই নয়, পুরো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, এই প্রবণতা এখন উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। একজন শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে সমাজের মানদণ্ড। তাদের নিয়ে এমন কটাক্ষ আসলে জ্ঞানের প্রতি অবজ্ঞা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাসনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে বিষয়টি নজরে এসেছে এবং প্রয়োজন হলে প্রশাসন তদন্ত শুরু করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ডিসিপ্লিনারি বোর্ড তা যাচাই করে থাকে। তাই সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো গুঞ্জনের ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।
এ ধরনের ঘটনার পেছনে বড় প্রশ্ন হলো- আমরা কি এখন এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে যাচাইয়ের আগে বিচার শুরু হয়ে যায়? সত্যকে যাচাই করার আগেই যখন মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়, তখন সেটি শুধু একটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, পুরো সমাজের ন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সত্য সবসময় ধীরগতিতে এগোয়, কিন্তু টিকে থাকে। আর গুজব যত দ্রুতই ছড়াক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত নিজেই ভেঙে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষিকাকে ঘিরে এই গুঞ্জন আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়- সংবাদ, গুজব আর কৌতূহলের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা জরুরি। সাংবাদিকতা বা সাধারণ নাগরিক দায়িত্ব- উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের উচিত প্রমাণ ছাড়া কোনো তথ্য প্রচার না করা। কারণ একবার কারও সম্মান নষ্ট হয়ে গেলে, সেটি ফিরিয়ে আনা যায় না। যাচাইহীন তথ্যের ভিড়ে যখন সত্য হারিয়ে যায়, তখন আমাদের কর্তব্য হয় সতর্ক থাকা। এই শিক্ষিকাকে ঘিরে যা-ই হোক না কেন, আমাদের মনে রাখা উচিত— প্রমাণহীন বিষয় সবসময় গুজব, কেবল সত্য হচ্ছে প্রকৃত সংবাদ।
লেখক: হাফিজ আল আসাদ , বিশ্লেষক ও সমাজ ভিক্তিক উন্নয়ন পরামর্শক সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট, এমডিসি বাংলাদেশ ডিরেক্টর আর্থ ফাউন্ডেশন।









