ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা নির্বাচনী পরিবেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নৈতিক কাঠামো নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। তফসিল ঘোষণার পরপরই কোনো প্রার্থীর ওপর সশস্ত্র হামলা হওয়া শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ সীমিত করে দেয়, কারণ এ ধরনের ঘটনা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা এবং আস্থাহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করে। যদিও হামলার পেছনে কারা বা কোন উদ্দেশ্যে এটি সংগঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে ঘটনাটি রাজনৈতিক যোগাযোগ, প্রচারণা-নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ করে।
হাদি নিজেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করছিলেন, এবং তার বিরুদ্ধে সামাজিক অবমূল্যায়নমূলক মন্তব্য বা পূর্বের হুমকির অভিযোগ প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু অংশে অনলাইন ও অফলাইন—দু’মুখী—হয়রানি একটি সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিক চাপের সঙ্গে সহিংসতার সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি প্রার্থীকে অবমাননা বা হুমকির মাধ্যমে দুর্বল করার প্রবণতা গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে হাদির বিরুদ্ধে পূর্বের হুমকিগুলো উপেক্ষিত থাকা কিংবা তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়া পরিস্থিতির ভঙ্গুরতাকে স্পষ্ট করে।
এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা পরীক্ষা হওয়া। রাজনৈতিক প্রচারণার সময় একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে লক্ষ্য করে চলমান সড়কে মোটরসাইকেল থেকে হামলা করা মানে হামলাকারীরা পরিবেশ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিল অথবা নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে ফাঁক ছিল। যে পর্যায়েই হোক, এটি নির্বাচনী নিরাপত্তা-ব্যবস্থার দুর্বলতার একটি ইঙ্গিত দেয়। তদন্ত এখনো চলমান থাকায় দায়সিদ্ধের কোনো অবতারণা করা যায় না, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তকে কেবল দ্রুত নয়, দৃশ্যমান ও পেশাদার করতে হবে—যাতে গুজব, বিভ্রান্তি বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা ছড়িয়ে না পড়ে।
ঘটনাটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চরিত্র সম্পর্কেও সমালোচনার সুযোগ তৈরি করে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া যে কোনো প্রার্থীর প্রতি সহনশীলতা ও নিরাপত্তার অভাব প্রমাণ করে গণতন্ত্রের বহুমুখী অংশগ্রহণ এখনো কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ছোট দল, স্বতন্ত্র প্রার্থী বা কম পরিচিত রাজনৈতিক ধারার ওপর হামলার ঝুঁকি বেশি থাকলে সেটি মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ ধরনের অসমতা দীর্ঘমেয়াদে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করতে পারে।
সরকারের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত নির্দিষ্ট: হামলাটিকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে বিবেচনা না করে আইনগত অপরাধ হিসেবে দেখা, তদন্তে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের জন্য আচরণবিধি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি, কারণ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, কটূক্তি কিংবা সামাজিক বঞ্চনার মতো মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রায়শই বাস্তব সহিংসতার পটভূমি তৈরি করে।
সর্বোপরি, এ ঘটনা প্রতিকূল রাজনৈতিক শক্তির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে যদি তদন্ত দুর্বল হয় বা হামলার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট থাকে। তাই এই মুহূর্তে প্রধান প্রয়োজন বাস্তব তথ্য উন্মোচন, প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধ এবং নিরাপদ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সক্ষমতা প্রদর্শন। কারণ তদন্তের মাধ্যমে স্পষ্ট জবাবদিহিই রাজনৈতিক পরিবেশে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
মো: হাফিজ আল আসাদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।









