টানা চার বছর পর ডলার সংকটের বৃত্ত থেকে বের হলো বাংলাদেশ। এখন ডলার খরচের চেয়ে আয় বেশি। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রয়েছে। নতুন করে ডলারের দাম বাড়ছে না। এটি ১২২-১২৩ টাকার মধ্যেই থাকবে। এছাড়া আমদানি বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। আমদানি ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি আগের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। তারপরও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। ডলারের কারণে সৃষ্ট প্রবল অর্থনৈতিক চাপও পর্যায়ক্রমে কমতে শুরু করেছে। তবে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব রোধে সরকার নানাভাবে ডলারের দাম ধরে রাখছে। ফলে ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলেও আপাতত ডলারের দাম কমছে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডলার সংকটের মূল কারণ ছিল দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুদ্রা পাচার বহুলাংশে কমে আসে। এর প্রভাবে ডলারের প্রবাহ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি হুন্ডি চ্যানেলগুলোয় লাগাম টানায় রেমিট্যান্সও বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের চলতি হিসাবে। তবে আইএমএফ বলেছে, মন্দা কেটে গেলেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। তখন আমদানিও বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, নয় বছর ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ে সরকারের কেন্দ্রীয় বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এরপর থেকে টানা আট বছর ১১ মাস এ হিসাবে আর ডলার উদ্বৃত্ত হয়নি। প্রতিবছর ঘাটতি বেড়েছে। গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত এ হিসাবে ঘাটতি ছিল। জুনে এসে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দেয়। পুরো অর্থবছর শেষে উদ্বৃত্ত দেখা দেয় ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই আট বছর ১১ মাস বা প্রায় ৯ বছর চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল।
ডলারের আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হলেই এ হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়। অব্যাহতভাবে এ ঘাটতি চলতে থাকলে ইঙ্গিত করে যে সামনে ডলার সংকট হবে। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এটি কোনোভাবেই আমলে নেয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় ১৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ঘাটতি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪৮৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আরও কমে ঘাটতি নেমে আসে ৪৫৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। করোনার সময়ে ব্যাপকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও এবং আমদানি ব্যয় কমলেও বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি থামেনি। আশঙ্কা করা হয়, ওই সময়ে দেশ থেকে ব্যাপকভাবে টাকা পাচার হচ্ছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হয়। এর প্রভাবে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। শুরু হয় ডলার সংকট। বেড়ে যায় ডলারের দাম। এসব কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। এরপর আমদানি ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় ঘাটতি আর এত ব্যাপকভাবে বাড়েনি। বরং কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি কমে দাঁড়ায় ৩৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘাটতি আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬০ কোটি ২০ লাখ ডলারে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৪৮০৬ কোটি ডলারে। এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে থাকে। কারণ করোনার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকলে আমদানি বাড়তে থাকে। যে কারণে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪৬২০ কোটি ডলার। অক্টোবরে সামান্য বেড়ে নভেম্বরে আবার কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৮৮ কোটি ডলারে। রিজার্ভ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক গর্ব করত। কিন্তু সেই গর্বের রিজার্ভ সংকট শুরু হলে তিন মাসও স্বস্তি দিতে পারল না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে আমদানি ব্যয় বাড়ায় রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। এপ্রিল এসে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। ওই বছরের জুন পর্যন্ত রিজার্ভ ৪ হাজার কোটি ডলারের ওপরে ছিল। জুলাইয়ে আকুর দায় শোধের পর রিজার্ভ ৪ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। অর্থাৎ ৩ হাজার ৯৬০ কোটিতে নেমে আসে। ২০২৩ সালের মে মাসে রিজার্ভ ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। অর্থাৎ ২ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। জুনে আবার বেড়ে ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলারে ওঠে। ওই বছরের জুলাইয়ে আবার ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে অর্থাৎ ২ হাজার ৯৭৩ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর থেকে ২০২৪ সালের জুন রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৬৮১ কোটি ডলারে নামে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৫৮২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ওই সময়ে নিট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি ডলার। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ছিল আরও কম। এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে নিট রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারে নেমে যায়।
নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া দেনা শোধ করতে থাকে। ফলে রিজার্ভও কমতে থাকে। নভেম্বরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৩৫ কোটি ডলারে। ডিসেম্বরে রিজার্ভ আবার বেড়ে ২ হাজার ৬২১ কোটি ডলার হয়। গত জুনে তা বেড়ে ৩ হাজার ১৭৭ কোটি ডলারে ওঠে। আগস্টে তা ৩ হাজার ৮৭ কোটি ডলারে রয়েছে।
রিজার্ভ যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে ২০২১ সালের আগস্টে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। সেপ্টেম্বরেই তা বেড়ে ৮৫ টাকা ২৬ পয়সায় ওঠে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওঠে ৮৬ টাকায়। একই বছরের মে মাসে ৮৭ টাকা ১৮ পয়সায় ওঠে। ২০২২ সালের জুন থেকেই ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়তে থাকে। জুনে বেড়ে হয় ৯২ টাকা। জুলাইয়ে ৯৩ টাকা ৮৮ পয়সা। আগস্টে ৯৪ টাকা ৯০ পয়সা। সেপ্টেম্বরে ৯৯ টাকা ৬৭ পয়সা। ওই মাসের শেষদিকে তা ১০০ টাকা অতিক্রম করে ১০১ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দামে ব্যাংকগুলোয় ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন প্রতি ডলার গড়ে ১৩০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল, যা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দাম ২০২৩ সালের জুনে ১০৮ টাকা ৩৪ পয়সায় ওঠে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়। ২০২৪ সালের মে মাসে শেষে এক লাফে বেড়ে ১১৭ টাকা ৯১ পয়সা হয়। জুনে হয় ১১৮ টাকা। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছিল ১১৮ টাকা। ওই বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে নতুন সরকার আগস্টে ডলারের দাম আরও বাড়িয়ে ১২০ টাকা করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ১২২ টাকা করা হয়। মে মাসে তা বেড়ে ১২২ টাকা ৯৬ পয়সায় ওঠে। আগস্টে আবার কমে ১২২ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে রয়েছে।