বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায়, যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্ন একত্রে মিলিত হয়ে একটি স্বাধীন জাতির সূচনা ঘটায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় ভিত্তি, যার ওপর বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো নির্মিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন তাই কেবল ঐতিহাসিক আলোচনা নয়; এটি রাষ্ট্রের বৈধতা, সার্বভৌমত্ব এবং আইনগত স্বীকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কারণে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করা রাজনৈতিক মতের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপের আওতাভুক্ত একটি গুরুতর আইনি প্রশ্ন।
সংবিধান নিজেই রাষ্ট্রের জন্মসূত্রে মুক্তিযুদ্ধকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রস্তাবনায় বর্ণিত জনগণের মুক্তিকামী সংগ্রাম, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণের অধিকার এবং সামরিক শাসনের প্রত্যাখ্যান—এসব উপাদান ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সংবিধানের ৭(২) ধারা রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সার্বভৌমত্বকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে স্বাধীনতা অস্বীকার করা মানে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে অস্বীকার করা। একইভাবে ৩৮ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রবিরোধী উদ্দেশ্যপ্রসূত সংগঠন, প্রচার বা কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে, যা ইতিহাস অস্বীকার বা রাষ্ট্রের অস্তিত্ববিরোধী বক্তব্যের ক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তি প্রদান করে। এই কাঠামোর ভেতরে স্বাধীনতা অস্বীকার কোনোভাবেই ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ হিসেবে সুরক্ষিত নয়, কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সাংবিধানিক ভিত্তিকে বিনষ্ট করার অধিকার দেয় না।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২৪এ রাষ্ট্রদ্রোহ, ১৫৩এ সাম্প্রদায়িক বা বৈরিতামূলক উসকানি, এবং ৫০৫ জনমনে অস্থিরতা সৃষ্টির মতো অপরাধগুলোকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। স্বাধীনতা অস্বীকার, সামরিক স্থাপনা ভাঙার হুমকি বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর বিরুদ্ধে উন্মুক্ত হুমকি এই ধারাগুলোর পরিসরে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ১৯৭১ সালের গণহত্যা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিকৃত তথ্য প্রচার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও অপরাধ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য, বিশেষত সামরিক স্থাপনা ও সার্বভৌম ক্ষমতার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হুমকি, আইনগতভাবে কেবল প্রতীকী অপরাধ নয়—এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো ও সাংবিধানিক অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত।
আন্তর্জাতিক আইনও এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর অন্যতম মৌলিক উপাদান, যা ICCPR এবং ICESCR চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ১৯৭১ সালের পরপরই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করে, এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্রসত্তার বৈধতা নিশ্চিত করে। গণহত্যার নথিভুক্ত ইতিহাস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নথির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। সেই কারণে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ বা মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনের বিরোধিতা নয়; এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নথি ও চুক্তির বিরোধিতা হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। গণহত্যা-অস্বীকার বহু দেশে শাস্তিযোগ্য; যদিও বাংলাদেশে নির্দিষ্টভাবে “জেনোসাইড ডিনায়াল ল” নেই, তারপরও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের অস্বীকার মানবতাবিরোধী অপরাধকে আড়াল করার প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
রাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা বা ক্যান্টনমেন্ট–জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর প্রতীক—এগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি রাজনৈতিক বক্তব্যের অংশ নয়, বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত হয়। অধিকাংশ দেশে এটি রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের হুমকি জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কারণ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাঠামো এবং প্রশাসনিক সংগঠন জন্ম নিয়েছে স্বাধীনতার অর্জনের ফলেই। ফলে এসব হুমকি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার পাশাপাশি জনগণের আত্মপরিচয়কেও আঘাত করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতবিরোধ স্বাভাবিক; রাজনৈতিক দল, সমর্থক বা নেতৃত্বের সমালোচনা গণতন্ত্রেরই অংশ। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে মতবিরোধ গণতান্ত্রিক মতভিন্নতা নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্মসূত্রকে প্রত্যাখ্যান। রাষ্ট্রের ইতিহাস অস্বীকার করা বা ভিত্তিকে অকার্যকর করে দেখানো দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রের মৌলিক পরিচয় বা স্বাধীনতা অস্বীকার গণতান্ত্রিক পরিসরকে ছিঁড়ে ফেলে, কারণ গণতন্ত্রের অস্তিত্বই নির্ভর করে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্রসত্তার ওপর।
১৯৭১ মানুষের সম্মিলিত সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামের ইতিহাস সাংবিধানিক নথিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এটি আর শুধু ইতিহাস নয়—রাষ্ট্রের আইনি পরিচয়। এই পরিচয় অস্বীকার কোনো রাষ্ট্রই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহ্য করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশে স্বাধীনতা অস্বীকার বা সামরিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি শুধু রাজনীতির বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো, সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নামান্তর।
মো: হাফিজ আল আসাদ ,রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।










