বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ তার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বজায় রেখেছে। ইন্দো প্যাসিফিক ইস্যুতে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করতে চায়। এটি তাদের উদ্দেশ্য।
বৃহস্পতিবার রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ল্যাভরভ বলেন, এটা সমাধানে আমরা জাতিসংঘসহ নানা প্ল্যাটফর্মে কাজ করছি। সঙ্কটের সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করছি যা অব্যাহত থাকবে। এ ইস্যুতে পশ্চিমারা চাপ দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে কোনো প্রক্সি ওয়ার দেখতে চায় না। বাংলাদেশ যে কোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত ঘন্টাব্যাপী দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিনিট দশেক একান্ত বৈঠক করেন। একান্ত এবং আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে সের্গেই লাভরভ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী রাশিয়া।
লাভরভ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অংশীদার এবং পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে অভিহিত করে জানান, ভবিষ্যতে দুই দেশের সর্বস্তরে সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। রাজনৈতিক সম্পর্ক কার্যকরভাবে জোরদারের জন্য সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে আলোচনা হচ্ছে তাঁদের।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমের গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে গম ও সার বিক্রির বিষয়ে স্থায়ী রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সের্গেই লাভরভ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অ্যাডহক ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনাকে সমর্থন করি। বাইরের পক্ষগুলো যেন (সমস্যা সমাধানে) অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে নিজেদের সীমিত রাখে। রাশিয়া এই কাজই মিয়ানমারের সঙ্গে করছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবে। এরপরও বাইরের কিছু শক্তি এই ইস্যুকে ব্যবহার করে একটি পক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি সামনে আনছে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, রাশিয়া মনে করে দুটো উদ্যোগই হিতে বিপরীত হবে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘ, আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামসহ নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে রাশিয়া এ সমস্যা নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এক প্রশ্নের জবাবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করি, তাহলে দেখব ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের নামে তাদের লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা, যা কার্যত বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ।
এদিকে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কি-না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।” আমরা ভারসাম্য কূটনীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিই। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা আলোচনার মধ্যে অনেক ইস্যু তুলে নিয়ে এসেছি। আমাদের ইস্যু ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এটা মোটামুটি যথা সময়ে শেষ হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ইস্যুতে তারা (রাশিয়া) আমাদের সঙ্গে একাত্ম।
রাশিয়া বাংলাদেশকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল আনার প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, তাঁদের দেশ থেকে আমরা এলএনজি আনতে পারি। তাঁরা আমাদের প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আনতে পারি।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, তাঁদের দেশে অর্থনৈতিক একটা কমিশন আছে, আমরা তার সুবিধা নিতে চাই। বাকি রাষ্ট্র যারা সদস্য, বিশেষ করে তাজিকিস্তান, তাদের অনুমতি লাগবে। সবাই মিলে যেন সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই দিনের সফরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছান রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন। বিমানবন্দর থেকে রুশ মন্ত্রী সরাসরি যান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। সেখানে বৈঠকে বসেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ড. মোমেনকে পাশে রেখে সংবাদ সম্মেলনে সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। দিল্লিতে শনিবার থেকে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকায় এলেন।
শুক্রবার সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর দিল্লি যাবেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে বিশেষ ফ্লাইটে সের্গেই লাভরভ ঢাকায় আসেন।