ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে নেটোর শীর্ষ বৈঠকে। কিন্তু অনেকটা বিফল মনোরথ হয়েই ফিরতে হয়েছে তাকে।
তিনি চেয়েছিলেন নেটোর কাছে আশ্বাস যে রাশিয়াার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হবার পর ইউক্রেন নেটোতে যোগ দিতে পারবে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর সামরিক জোটের সদস্যপদ পাওয়ার নিশ্চিত আশ্বাস ছিল তার দেশের জনগণের জন্য একটা আশার আলো, দেশটিতে শান্তির একটা চূড়ান্ত নিশ্চয়তা এবং রাশিয়ান সৈন্য আরও কখনও ইউক্রেনের মাটিতে পা রাখতে পারবে না এমন একটা ভবিষ্যত আশার বার্তা।
কিন্তু তার বদলে মি. জেলেনস্কিকে সোজাসুজি বলে দেওয়া হয়েছে “মিত্র জোট যখন একমত হবে এবং তাদের শর্তগুলো পূরণ করা হবে” তখন ইউক্রেনকে এই জোটের সদস্য হবার আমন্ত্রণ জানানো হবে। অর্থাৎ সোজা কথায় – কোন প্রতিশ্রুতি নেই।
বৈঠক শুরুর আগেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যে কড়া ভাষায় তার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। শীর্ষ বৈঠকের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন নেটোর নেতারা যে এমনকি একটা সময়সূচি দিতেও রাজি নন সেটা নেহায়েতই “অযৌক্তিক”। তিনি বলেন শর্তগুলোও “ধোঁয়াটে”।
এছাড়াও জেলেনস্কি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এ কারণে যে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ পরবর্তী আলোচনায় নেটো যে কোনভাবে ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইবে।
১১ জুপশ্চিমা সাহায্যের জন্য ইউক্রেনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ- বলছেন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী
কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নেটোর নেতৃবৃন্দের সাথে মুখোমুখি কথা বলার পর কূটনৈতিক ক্ষোভের ঝড় কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। বুধবার তারা একরকম মি. জেলেনস্কিকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন এই বলে যে পরিস্থিতি বদলেছে এবং ইউক্রেন নেটোতে যোগ দেবে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন ইউক্রেন নেটো জোটেই আছে। নেটোর মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন বুধবার তারা সমকক্ষ হিসাবেই বৈঠক করেছেন, কিন্তু জোটের মিত্র সদস্য হিসাবে তারা বৈঠক করবেন ভবিষ্যতে।
এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মি. জেলেনস্কিকে বলেছেন সদস্যপদ ভবিষ্যতে আসবে। ইউক্রেনের সদস্য হবার সম্ভাবনা নিয়ে নেটো আনুষ্ঠানিকভাবে কতটা নিশ্চয়তা দেবে তা সীমিত রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন মি. বাইডেন। তিনি মি. জেলেনস্কিকে বলেছেন ইউক্রেন সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন যে এই শীর্ষ বৈঠকে এটা দেখা গেছে ইউক্রেনকে নেটো পরিবারভুক্ত করার জন্য একটা গ্রহণযোগ্যতার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তত কোন দেশ এখন এই শব্দটা উচ্চারণ করছে না যে, ইউক্রেন “যদি” নেটোতে যোগ দেয়…! এখন বলা হচ্ছে ইউক্রেন “যখন” নেটোতে যোগ দেবে!
এসবই নেটোর শীর্ষ বৈঠক থেকে মি. জেলেনস্কির প্রত্যাশার ঝুলিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক উষ্ণ কিছু কথাবার্তা।
এরপরেও তার জন্য ইতিবাচক কিছু ঘটেছে নেটোর বৈঠকে: তিনি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে নেটোয় সদস্যপদের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া সহজ করা হবে, নতুন নেটো-ইউক্রেন কাউন্সিল গঠন করা হবে- এই কাউন্সিলের মাধ্যমে কিয়েভ চাইলে জোটের বৈঠক ডাকতে পারবে, এবং, সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি- বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর কিছু দেশের কাছ থেকে নতুন ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
জি-৭-এর নেতারা বলেছেন ইউক্রেন নেটোতে যোগ দেবার আগে পর্যন্ত রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করতে ইউক্রেনকে তারা নতুন এক থোক দ্বিপাক্ষিক সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে রাজি আছেন।
এর মধ্যে থাকবে আরও বিমান প্রতিরক্ষা সহায়তা, দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং এমনকি যুদ্ধবিমান, সেইসঙ্গে আরও প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ এবং সাইবার প্রযুক্তি খাতে সাহায্য।
মি. জেলেনস্কি একে আখ্যা দিয়েছেন “নিরাপত্তা খাতে উল্লেখযোগ্য বিজয়” বলে।
যে মন্তব্যে জলঘোলা
তবে, একটা নেতিবাচক বা অসঙ্গতিপূর্ণ মন্তব্য এসেছে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের কাছ থেকে। সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় তিনি ইউক্রেনের উদ্দেশ্যে একটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন ইউক্রেনকে যে সমর্থন ও সহযোগিতা ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে তার জন্য দেশটির আরও কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত।
তিনি বলতে চেয়েছেন এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কোনরকম উস্কানিমূলক মন্তব্য নয়, বরং সমর্থক একটা মিত্র দেশের কাছ থেকে বন্ধুসুলভ পরামর্শ। তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেবার ব্যাপারে দেশগুলোর ওপর – বিশেষ করে আমেরিকার ওপর- যে কতটা রাজনৈতিক চাপ আছে সেটা ইউক্রেনের বোঝা উচিত।
তিনি বলেন, অস্ত্রশস্ত্রের একটা ফর্দ নিয়ে ওয়াশিংটনে হাজির হওয়া – যেন আমেরিকা অ্যামাজনের মত একটা দোকান- চাইলেই সেগুলো কিনে দেয়া যাবে – সেটা অবশ্যই সেদেশে কিছুটা “অস্বস্তি” তৈরি করেছে।
তবে নেটোর শীর্ষ বৈঠক, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জোটের মধ্যে ঐক্য আছে তা দেখানো, সেখানে এধরনের মন্তব্য নিঃসন্দেহে অকূটনৈতিক। ঋষি সুনাক প্রকাশ্যে এই মন্তব্যের সাথে সহমত হননি, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন ইউক্রেন সবসময়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
মি. জেলেনস্কির সংবাদ সম্মেলনে যখন মি. ওয়ালেসের এই মন্তব্য নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়, তখন তাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। তিনি পাশে বসা তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলেন – মি. ওয়ালেসকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন।
এই ঘটনা নিয়ে মুখরোচক কিছু সংবাদ শিরোনাম হয়ত নেটো এবং ব্রিটিশ সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রায় আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনের দাবি-দাওয়া পশ্চিমের দেশগুলো শুনেছে এবং মূলত দেশগুলো তাতে সাড়াও দিয়েছে। কিন্তু কিয়েভ সবসময়েই পশ্চিমের সাড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছে। ইউক্রেন সবসময়েই আরও সাহায্য চেয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো অবশেষে ইউক্রেন যা চেয়েছে তা দিয়েছে। কাঁধ থেকে ছোঁড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে সাঁজোয়া যান, লড়াইয়ের উপযোগী শক্তিশালী ট্যাংক এবং এখন এমনকি ক্লাস্টার বোমা।
কিন্তু ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে সদস্যদের কাছ থেকে এসেছে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে সোজাসাপ্টা ও স্পষ্ট উত্তর – না মানে না।
আমেরিকার নেতৃত্বে নেটো ইউক্রেনের দাবির কাছে মাথা নোয়াতে রাজি হয়নি। জোটের সদস্য হিসাবে যোগদানের প্রক্রিয়ায় ইউক্রেনের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে দ্রুত তাকে সদস্য করার ব্যাপারে নেটো কৌশলগতভাবে সতর্ক থাকার পথই বেছে নিয়েছে।
ফলে নেটোর এই সম্মেলন ছিল প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য পশ্চিমের কূটনৈতিক মনোভাব যাচাইয়ের একটা সুযোগ মাত্র। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোকেও এখন তাদের নিজের দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে এবং সেসব বিবেচনায় নিয়েই যে বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে তাদের কাজ করতে হবে সেটা অনস্বীকার্য। মূল কথা হল – আপনি যেটা চাইছেন সেটা সবসময় যে পাওয়া যাবে না এটা মেনে নেওয়া। বিবিসি বাংলা।