শনিবার, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে নানামুখী আশঙ্কায় ভারত

ভারতের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক মধুর নয়, ইউনূসের ক্ষেত্রেও একই রকম, বিএনপি’র সঙ্গেও অতীতে বিরোধ ছিল। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে তাই ভারতের সামনে রয়েছে কঠিন অঙ্ক-এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার চলছে। তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের যে খুব বেশি আলাপ আলোচনা হয়েছে, এমন নয়। বরং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে শীতল সম্পর্কই বারবার সামনে এসেছে।

এই সময়ে বাংলাদেশ ভারতে আশ্রয় নেওয়া তাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের কাছে ফেরত পাঠানোর দাবি করেছে, কিন্তু সেই দাবি পূরণে কোনো উৎসাহ দেখায়নি ভারত। আবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রসঙ্গ ভারত একাধিকবার তুলেছে। বাণিজ্য নিয়ে কড়াকড়ি হয়েছে।

আবার অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অতটা ভালো ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা ভারতের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ভারত বারবার একটা বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা জরুরি বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নয়। তারা মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার অল্প কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায় আছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই তারা কথা বলতে আগ্রহী।

গত ২০ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ভারত আবার জানাতে চায়, আমাদের প্রত্যাশা হলো বাংলাদেশে দ্রুত অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও ইনক্লুসিভ নির্বাচন হোক, যেখানে মানুষ তাদের রায় দিতে পারবে এবং মানুষ কী ভাবছে, তা বোঝা যাবে।

এর মধ্যে ‘ইনক্লুসিভ’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইনক্লুসিভ মানে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সহজ বাংলায় সবাইকে নিয়ে নির্বাচন চায় ভারত।

এই কূটনীতির ভাষার মধ্যে দিয়ে ভারত একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের প্রত্যাশা হলো আওয়ামী লীগও যেন নির্বাচনে লড়তে পারে। যদিও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই তারা আগামী নির্বাচনে লড়তে পারবে না।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান, গুরুত্ব, পছন্দ বোঝার ক্ষেত্রে এই বিষয়টা মাথায় রাখা খুবই জরুরি।

ভারতের পছন্দ-অপছন্দ

ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লড়তে পারবে না, এটা ধরে নেওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রথম চাওয়া হবে, বাংলাদেশে যেনো ভোটের পর একটা স্টেবল বা স্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

একই কথা বলছেন প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরী। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ভারত নিজের স্বার্থেই চাইবে না, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশে অস্থির সরকার হোক। ফলে স্থায়িত্ব তো ভারত নিঃসন্দেহে চাইবে।

শ্রীরাধা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারত বিএনপি-কেই ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। কারণ, জামায়েত ও এনসিপি-কে নিয়ে ভারত খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী নয়।

অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার এবং রাজ্যসভার সাবেক সাংসদ জহর সরকার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, এখন যে দলগুলো নির্বাচনে থাকছে, তার মধ্যে বিএনপি সবচেয়ে পুরনো দল। আওয়ামী লীগের ভোট তো কোথাও একটা যাবে। বিএনপি’র সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণপন্থিদের ধাক্কায় বিএনপি সেন্টার থেকে সেন্টার লেফটে চলে গেছে। এনসিপি নতুন দল, শিকড় গজায়নি। তাদের জেতার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তারা অন্য দলের ভোট কাটবে। দক্ষিণপন্থিদের ভোট কাটলে বিএনপি-র সুবিধা হবে, বিএনপির কাটলে দক্ষিণপন্থিদের সুবিধা হবে।

কিন্তু তিনি মনে করেন, এখানে ভারতের চাওয়া-পাওয়ার খুব বেশি গুরুত্ব নেই। বাংলাদেশের মানুষ যাদের ক্ষমতায় আনবে, ভারতকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ভারতের নীতি কী হবে?

জহর সরকার মনে করেন, ভারতকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে হবে। ভারত এই অবস্থান নিক, বাংলাদেশ ঠিক করুক, কারা ক্ষমতায় আসবে।

শ্রীরাধার মতে, এবারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯৬ সালের থেকে আলাদা। কোনো সন্দেহ নেই, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের দিক থেকে ভালো হবে। জামায়াতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। এনসিপি-র সঙ্গে ভারতের কোনো যোগাযোগই তৈরি হয়নি।

জয়ন্ত বলেছেন, ভারত মনে করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত মানুষরা ভারত-বিরোধী কথা বলেছেন, অবস্থান নিয়েছেন। ভারতের সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো, বাংলাদেশের জমি যেন ভারত-বিরোধী কাজে ব্যবহার না করা হয়। আর জামায়াতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না।

শ্রীরাধার প্রশ্ন, নির্বাচনটা কি বিএনপি বনাম জামায়েত হবে? জামায়েত সমর্থিত ছাত্রশিবির যেভাবে ডাকসু নির্বাচনে জিতেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, ওরা এবার প্রস্তুত হয়ে ভোটে নেমেছে ও নামছে। সেক্ষেত্রে ভারতের পছন্দটাও স্পষ্ট থাকবে।

জহর সরকার মনে করেন, শেষের দিকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন ও দুর্নীতির বিষয়টা জেনেও ভারত তাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। এটা ঠিক নীতি নয়। আবার শেখ হাসিনা সবসময় ভারতের সঙ্গে থেকেছেন, তাই তাকে ত্যাগ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।

সবমিলিয়ে ভারতের সামনেও পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। অনেক কঠিন অঙ্ক কষতে হবে ভারতকে। সেই অঙ্কে জড়িয়ে থাকবেন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, জামায়েত, ইউনূস, এনসিপি এবং নিজেদের স্বার্থের বিষয়টি।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ