বরিশাল সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যের বৈঠকে আসেননি সাদিক, যাননি খোকন। এ ঘটনায় নৌকার জন্য অশনি সংকেত হিসাবে দেখছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা। তবে ভোটের মাঠে প্রচারণায় তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদের কথা বলছেন জোরালোভাবে।
শেষমেষ বিশেষ বর্ধিত সভায় গেলেন না বরিশাল সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। ছিলেন না বর্তমান মেয়র নগর আওয়ামী লীগ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহও। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে শুক্রবার বিকালে গৌরনদী পৌরসভা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ওই সভা।
জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, বরিশাল মহানগর ও নগরীর ৩০টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সভায় ছিলেন বরিশালের ৪টি আসনের সংসদ-সদস্যরা। নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য কেন্দ্রের করে দেওয়া টিমের সদস্যরাও ছিলেন সেখানে। কেবল ছিলেন না প্রার্থী খোকন ও মেয়র সাদিক।
বিষয়টিকে নৌকার জন্য অশনি সংকেত হিসাবে দেখছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা। যদিও সভায় দেওয়া শুভেচ্ছা বক্তব্যে নৌকার বিজয় নিশ্চিতে সর্বশক্তি নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান কেন্দ্রীয় টিমের প্রধান পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি।
তারপরও খোকনের সেখানে না যাওয়ার বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন সবাই। তারা গেলে বিভাজনের বরফ গলত বলে ধারণা অনেকের। বর্তমান পরিস্থিতিতে দু’পক্ষের মধ্যে বিরাজমান বিভক্তির সীমারেখায় উঠল দেয়াল। এই দেয়াল টপকে বিজয় নিশ্চিত করা কঠিন-বলছেন নৌকার সমর্থকরা।
ভাতিজা সাদিক আব্দুল্লাহ ও চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের মধ্যে বহু আগে থেকেই চলছে পারিবারিক বিরোধ। সাদিক মেয়র হওয়ার পর আরো তুঙ্গে ওঠে তা। দলীয় মনোনয়ন প্রশ্নে সাদিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান খোকন। শেষ পর্যন্ত নৌকার মনোনয়নও পান তিনি। এরপর থেকেই স্পষ্ট দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। সাদিক-বিরোধীরা অবস্থান নেন খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে।
অন্যদিকে সাদিকের সঙ্গে থাকেন জেলা, মহানগর ও নগরের ৩০ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। খোকনের বড় ভাই মেয়র সাদিকের বাবা হাসানাত আব্দুল্লাহকে প্রধান করে নির্বাচন সমন্বয় টিম গঠন করে কেন্দ্র। হাসানাতও ঘোষণা দেন ছোট ভাইয়ের পক্ষে কাজ করার। মনে যাই থাক মুখে একই ঘোষণা দেন মেয়র সাদিকও। তবু দুই ভাগেই বিভক্ত থাকে দল।
সাদিক-বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে চলতে থাকে খোকনের প্রচারণা। নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতেও রাখা হয়নি তাদের। পালটা হিসাবে ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকে সাদিকপন্থিরা। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার গৌরনদীতে ডাকা হয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা। সিটি নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয় খোকনকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে যাননি খোকন। মেয়র সাদিকও আসেননি সভায়।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাসানাত ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ‘হাসানাত আব্দুল্লাহর সম্মতি না থাকার কারণেই আসেননি সাদিক। ভাতিজার সঙ্গে চাচার বিরোধ এখন প্রতিষ্ঠিত বরিশালে। নির্বাচনি প্রচারণার নানা বক্তব্যেও সরাসরি সাদিকের বিরুদ্ধে বলছেন খোকন। এই অবস্থায় সভায় সাদিক থাকলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাছাড়া খোকন অনুসারীদের অনেকেই প্রকাশ্য বক্তব্যে বলছেন সাদিক এলে ভোট কমার কথা। তাই বিতর্ক এড়ানো আর দায় কাঁধে না নেওয়ার টার্গেটেই ছেলেকে সভায় আনেননি হাসানাত।’
সাদিক আসুক বা না আসুক খোকন সেরনিয়াবাত সভায় থাকবেন এই আশা ছিল সবার। তিনি না যাওয়ায় দেখা দেয় হতাশা। যদিও বিষয়টি যতদূর সম্ভব চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন উপস্থিত কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতারা।
সভার শুরুতে দেওয়া শুভেচ্ছা বক্তব্যে হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘খোকন সেরনিয়াবাত আমার স্নেহের ছোট ভাই। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে। বাবাসহ পরিবারের অনেককেই হারিয়েছে আমার মতো। এটা ঠিক যে সাদিক মনোনয়ন না পাওয়ায় অনেকে কষ্ট পেয়েছেন। সেই দুঃখ আর হতাশা কাটিয়ে এবার নৌকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দলীয় সভানেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তাকে যে কোনো উপায়ে বিজয়ী করতে হবে আমাদের। এই লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৌকার সম্মান। কোনো অবস্থায় সেই সম্মান হারানো যাবে না। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।’
হাসানাতের এই বক্তব্যের সময় তুমুল হাততালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান উপস্থিত নেতা-কর্মীরা।
বড় ভাই হাসানাতের এই বক্তব্যের সময় ছোট ভাই খোকন উপস্থিত থাকলে গৌরনদীর এই মাঠ থেকেই নৌকার পালে বিজয়ের হাওয়া লাগতো উল্লেখ করে সভায় উপস্থিত এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘বরিশালের রাজনীতিতে হাসানাত আব্দুল্লাহর অবস্থান যে কতটা শক্তিশালী তার প্রমাণ এই সভা। খোকনকে ঘিরে দলে স্পষ্ট বিভক্তি সৃষ্টি হলেও বর্ধিত সভায় যোগ দেন বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতারা। এমনকি মেয়র সাদিককে সরাসরি ‘হায়েনা’ আখ্যা দেওয়া বরিশাল-৫ আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিমও ছিলেন সভায়। এখানে অনুসারীদের নিয়ে খোকন সেরনিয়াবাত এলে দু’পক্ষের মধ্যে একটা মিলনমেলা হতো। নির্বাচনী মাঠে আরও এগিয়ে যেত নৌকা। সেই সুযোগটা কেন হাতছাড়া করলেন খোকন সেটাই প্রশ্ন।’
সভায় খোকনের না যাওয়া নিয়ে অবশ্য মিলেছে ভিন্ন তথ্য। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে খোকন ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘প্রচার প্রচারণা প্রশ্নে মেয়র সাদিকের অত্যাচার নির্যাতন-বিরোধী বক্তব্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রার্থী। আওয়ামী লীগ তথা বরিশাল কেবল একটি পরিবারের কতিপয় সদস্যের কাছে কিভাবে জিম্মি ছিল সেটাই বারবার সামনে আনা হচ্ছে প্রচারণায়। বরিশালের মানুষ সাদিক ও তার পরিবারকে পছন্দ করে না। এই অপছন্দের বিষয়টিকে পুঁজি করেই জিততে চাইছে নৌকা। এমন পরিস্থিতিতে হাসানাতের সভায় গেলে ভুল বার্তা যেত ভোটের মাঠে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের যে একটা সমর্থন এখন নৌকার পক্ষে সেটা থাকত না। এ কারণেই সভায় যাননি খোকন।’
নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাড. লস্কর নূরুল হক বলেন, ‘নগরে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া এবং প্রচার-প্রচারণার ব্যস্ত থাকার কারণে সেখানে যেতে পারেননি প্রার্থী।’ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য খোকন সেরনিয়াবাতকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ধরেননি তিনি।
হাসানাত আব্দুল্লাহ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কেন্দ্রীয় টিমের সমন্বয়ক ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. আফজাল হোসেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মি আহম্মেদ, কার্যনির্বাহী সদস্য আনিসুর রহমান, গোলাম রব্বানী চিনু, বরিশাল-২ আসনের এমপি মো. শাহে আলম, বরিশাল-৪ আসনের এমপি পঙ্কজ দেবনাথ, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি রুবিনা আক্তার মীরা, সাবেক এমপি হিরনপত্নী জেবুন্নেসা আফরোজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীর।