প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চার নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগ করেছেন।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে, আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সৌজন্য মতবিনিময়’ অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ও অন্য চার কমিশনার। সেখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আগামীতে আমাদের দেশকে প্রবল সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে আরও সুন্দর একটি বাংলাদেশ সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আমরা সবাই আশাবাদী, সেই স্বপ্ন অচিরেই বাস্তবায়িত হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশে প্রশাসন, বিচার, নির্বাচন সব কিছু অনেক সুন্দর হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও ছিল অনেক বিতর্ক। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসন আমলে হয়েছে, ফলাফল নিয়ে ছিল বিতর্ক। ১৯৯১ এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে হয়েছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের হয়েছিল।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৭টি ও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কে ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান (সেফ এক্সিট) বিষয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনা সমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দর কষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সেই প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধান মতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচন ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচন বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল। বিএনপি আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি, আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, যোগ করেন তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বা ব্যবস্থাপনায়। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন সেই অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব বিষয়।
নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সেই কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কত দিনের জন্য স্থগিত করা যাবে তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে কোনো কমিশন পদত্যাগ করেননি, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে-দলের মধ্যে নয়। ২৯৯টি আসনে এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ ও দায়-দায়িত্ব সব সময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সব সময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সকল নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত-সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচনগুলো সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার প্রেরণ, কিছু উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএমের ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একই দিনে তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে তিন থেকে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল, ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল।
নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজন ছিল না। আমি স্পষ্ট করে বলছি, নির্বাচন যেহেতু একদলীয় ছিল, কাজেই এই নির্বাচনকে সরকারিভাবে প্রভাবিত করা কোনো আবশ্যকতা কার্যত ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে-মধ্যে হয়নি, যোগ করেন তিনি।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুবছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা, অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৗক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন না করে বা বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন কোনো উদাহরণ নেই।
সরকার বারবার বলছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।
তিনি বলেন, কমিশনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের কর্মকালে আমরা গণমাধ্যম, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আবশ্যক সবার সহযোগিতা পেয়েছি। আমি আজ বিদায় লগ্নে কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করছি। বর্তমান ও অতীতের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মধ্যে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে আমাদের ধারণা ভবিষ্যতের জন্য উত্তম হবে। অধিকন্তু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে, যোগ করেন তিনি।
বক্তব্য শেষে হাবিবুল আউয়াল তার পদত্যাগপত্র কমিশন সচিবের হাতে তুলে দেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি কমিশন থেকে বের হয়ে যান।