জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর অপসারণ ও তার মরণোত্তর বিচার করতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে ‘মায়ের কান্না’।
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নুরে আলমের সঞ্চালনায় মায়ের কান্নার সভাপতি মো. কামরুজ্জামান মিঞা লেলিনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত সদস্য এবং ফাঁসি দেওয়া সদস্যদের পরিবারবর্গ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিমানবাহিনীর কর্পোরাল লরেন্স রোজিও জেমস বলেন, “বিনাবিচারে শত শত বিমানবাহিনী সদস্যকে হত্যা করেছে। প্রথমে ফাঁসি দিয়েছে, পরে রায় প্রকাশ করেছে। আইনকে তোয়াক্কা করা হয়নি। জিয়াউর রহমান জঘন্যতম কাজ করেছে। স্বাধীন দেশেও বিচারবহির্ভূত হত্যার পর লাশ পরিবারকে দেওয়া হয়নি। দেড়-দুই হাজার লোক গুম করা হয়েছে। ৭৭ বছরেও আমরা এর সুবিচার পাইলাম না।”
তিনি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের দাবি করেন।
১৯৭৭ সালের এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কর্পোরাল নূরুল ইসলাম বলেন, “আমরা কয়েকজন বেঁচে আছি। বাকিদের ফাঁসি হয়ে গেছে। আমাকে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। চোখ হাত-পা বাঁধা ছিল। চার বছর সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করেন। এছাড়া যারা মারা গেছে ও বেঁচে আছে তাদের সবার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবি জানান।
কর্পোরাল গোলাম মাওলা হিরু বলেন, “১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর জিয়ার ষড়যন্ত্রের শিকার হই। দীর্ঘ সময় আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমাকে ২০ বছর কারাদণ্ড দিয়ে জেলে রাখা হয়েছে। আমি অন্যায়ের বিচার দাবি করি।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জাপান রেড আর্মির সদস্যরা জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেন। সেই বিমানটি জোরপূর্বক ঢাকা বিমানবন্দরে (পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে) অবতরণ করায়। বিমান হাইজ্যাক এবং যাত্রী জিম্মির ঘটনায় ঢাকা সেনানিবাস এবং বিমানবন্দর এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পরিকল্পিতভাবে একটি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন পরবর্তী সময়ে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে। জিয়াউর রহমান একদিনের সামরিক আদালতে বিচার করে সেই রাতেই ফাঁসি সম্পন্ন করে গুম করতেন ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর ও বগুড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে। রাতের আঁধারে কারফিউ দিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হতো। কোনো প্রকার ধর্মীয় সৎকার ছাড়াই লাশগুলো ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে, কুমিল্লার টিক্কারচর কবরস্থানে মাটিচাপা দেওয়া হয়। সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের কথিত বিচারে ফাঁসি হওয়া ২০৯ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ওই ঘটনার জেরে মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৪৩ জন। তেমনি কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন সেনা ও বিমানবাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য।”
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা আইনজীবী নিয়োগের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ এই মানুষগুলোকে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে দীর্ঘদিন পরিবারগুলোর কাছে এই তথ্য অজানা ছিল। জানা ছিল না কোথায় তাদের কবর।”
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হওয়া ১২১ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। কুমিল্লা কারাগারে ৭২ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। বগুড়া কারাগারে ১৬ জন, রংপুরে ৭ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। কিন্তু বিমানবাহিনী সদর দপ্তরের হিসাবে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর পরবর্তী সময়ে ৫৬১ জন সৈনিক নিখোঁজ হয়েছেন। যাদের কখনই আর খুঁজে পাও যায়নি।
মায়ের কান্নার ৫ দফা দাবি
সংবাদ সম্মেলনে পাঁচটি দাবি উত্থাপন করেছে মায়ের কান্না। দাবিগুলো হলো-
১. ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর তথাকথিত সামরিক বিদ্রোহ দমনের নামে যাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের কোথায় সমাহিত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই স্থান চিহ্নিত করে দিতে হবে।
২. জিয়া কর্তৃক যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ এবং শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
৩. অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া, কারাদণ্ড এবং চাকরিচ্যুত সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের, স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র্যাংকে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা, পেনশনসহ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন ও সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. জিয়ার মরণোত্তর বিচার করতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৫. জিয়ার কবর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা কবর অপসারণের প্রাথমিক কাজ শুরু করবেন।