দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। এতে ছাত্রদল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), ইসলামী ছাত্রশিবির, বামপন্থি সংগঠন, স্বতন্ত্রসহ আট প্যানেলে ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা ভোট করছেন। আজ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। এ লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জাকসু নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক দিক তুলে ধরে ব্রিফ করেন মঙ্গলবার।
জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মোট ভোটার ১১৮৯৭ জন। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদে প্রায় ৫৪৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ১০২ জন। ফলে মোট প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। ২১টি হলে ২২৪টি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদের ১১টি এবং ছাত্রীদের ১০টি হলে রয়েছে ভোটকেন্দ্র। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ২১টি হলে ২১ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৬৭ জন পোলিং অফিসার এবং ৬৭ জন পোলিং অফিসার সহায়ক হিসাবে কাজ করবেন। এছাড়া প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। এই নির্বাচনে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ভোটকেন্দ্র সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। নিরাপত্তা জোরদার করতে ১২০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে বলে জানান নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক রাশিদুল আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে কমিশন প্রস্তুত। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন থাকবে। এর মধ্যে সাদা পোশাকেও সার্বক্ষণিক নজর রাখবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর নিরঙ্কুশ জয়ের প্রভাব জাকসুতে পড়তে পারে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। জাকসুতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থীরাও এ বিষয়ে আশাবাদী। তারা বলেন, ডাকসুতে শিবিরের বড় জয় হতে পারে আমাদের জয়ের অন্যতম কারণ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করি বলে আমাদের এত জনপ্রিয়তা। শিক্ষার্থীদের হয়ে কাজ করা আমাদের অন্যতম অঙ্গীকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রুবিনা জাহান তিথি বলেন, ঢাবির সঙ্গে জাবিকে শতভাগ মেলানো ঠিক হবে না। জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েদের ভোট পাওয়ার জন্য সান্ধ্য আইন আসবে, বটে আড্ডা দেওয়া যাবে না, ১০টার পরে হলে ঢুকলে বাসায় কল যাবে-এ ধরনের আলাপ উঠে আসছে, এগুলো আসলে কত পারসেন্ট ছাত্রীকে আকৃষ্ট করছে? বটতলা কিংবা টিএসসির বাইরেও বিশালসংখ্যক জাবিয়ান নারী আছেন, যারা কেবল হল টু ডিপার্টমেন্ট টাইপ মানুষ। ওনাদের কি আসলে বটের আড্ডা অফ হয়ে গেলে অথবা সান্ধ্য আইন এলে কিছু আসে যায়? প্রার্থীদের জেতার জন্য কিন্তু এই নারীদের ভোটও লাগবে। মেয়েরা অন্য কোনো কিছুতে ভুলে নয়, নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী ভোট দেবে।
সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্যাহ বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে চলা প্রচারণায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, এটি ভালো দিক। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। তাদের অধিকার আদায়ে সদা অঙ্গীকারবদ্ধ আমাদের প্যানেল। আশা করি, ১১ সেপ্টেম্বর ব্যালটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করে নেবেন।
জিএস পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, অনেক প্রার্থী এমন ইশতেহার ঘোষণা করেন যা পূরণ করা সম্ভব নয়। আমাদের ইশতেহারে এমন কিছু নেই। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করতে চাই। শিবির কারও ওপর আদর্শ চাপিয়ে দেয় না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আমরা কাজ করে যাব।
এদিকে জাকসু নির্বাচনে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিল করা হয় ভোটের একদিন আগে। এর প্রতিবাদে প্যানেলের প্রার্থীরা জাকসু নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রাতভর অবরুদ্ধ করে রাখেন। এই ঘটনা সমাধানের দাবিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, প্রার্থিতা ফিরে পেতে সোমবার হাইকোর্টে (৮ সেপ্টেম্বর) রিট করেন অমর্ত্য। এরপর আদালতে শুনানি শেষে অমর্ত্য রায় প্রার্থিতা ফিরে পান। পরে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আপিল করা হয় চেম্বার জজ আদালতে। সর্বশেষ তথ্যমতে, অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছেন চেম্বার জজ আদালত।
নির্বাচনের একদিন আগে কেন অমর্ত্যরে প্রার্থিতা বাতিল করা হলো এবং ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে কি না, না হলে তার প্রার্থিতা পুনর্বহাল দাবি নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের সামনে জমায়েত হন ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী ও সমর্থকরা। একপর্যায়ে তারা উপাচার্য ও নির্বাচন কমিশনকে সিনেট হলের ভেতরে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেন। আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আদালতের রায়ের ব্যাপারে নিজেদের অপারগতা জানান। রাত ১১টার দিকে উপাচার্য কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা দরজা বন্ধ করেন।
সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেলের প্রার্থীরা দাবি করেন, অমর্ত্যরে প্রার্থিতা বাতিলের আদেশ অবৈধ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করেছে। তার প্রার্থিতা ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা নিজেরাও সেখান থেকে যাবেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নির্বাচন কমিশনকেও সেখান থেকে যেতে দেবেন না।
আদালতের রায়ের ঘটনায় উপাচার্য ও নির্বাচন কমিশনকে অবরুদ্ধ করার কারণ জানতে চাইলে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের এজিএস পদপ্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি বলেন, ‘জাবি প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে অমর্ত্যরে প্রার্থিতা বাতিল করেছে। আদালতের কাছে ‘ব্যালট ছাপা হয়ে গেছে’-এমন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে অমর্ত্যরে প্রার্থিতা বাতিল করানো হয়েছে। যদি ব্যালট ছাপানো হয়েই থাকে, তাহলে আজ (বুধবার) ডোপ টেস্টে যাদের ফলাফল পজিটিভ এসেছে, তাদের নাম ব্যালট পেপার থেকে বাদ দেওয়া হবে কীভাবে? যদি ব্যালট পেপার ছাপানো না হয়ে থাকে, তাহলে আদালতের মাধ্যমে অমর্ত্যরে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা প্রশাসনের কাছে সুস্পষ্ট সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত সিনেট ভবন ত্যাগ করব না।’ এ সময় তথ্য সংগ্রহ করতে সাংবাদিকরা কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে তারা বাধা দেন। জানান ভেতরে আলোচনা চলছে। তবে নির্বাচন কমিশন জানায় তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘এটা আদালতের রায়। চাইলেই তো আমরা পরিবর্তন করে ফেলতে পারি না। তবে আমি চাই সমস্যার সমাধান হোক। কীভাবে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ চাই।’
জাকসুর ২৫ পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস)সহ ২৫টি পদে চূড়ান্ত ভোট পরীক্ষায় রয়েছেন ১৭৭ জন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), বামপন্থি সংগঠন ও স্বতন্ত্রসহ আটটি প্যানেলের মধ্যে এ লড়াই হবে আজ বৃহস্পতিবার। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাগছাস, ছাত্রদল, বামপন্থি’ সংগঠনের একাংশ বিভিন্ন নামে চারটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল রয়েছে। অন্যরা আংশিক প্যানেলে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস রয়েছে। ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আজ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। ২১টি হলের ২২৪টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ ওএমআর মেশিনে ভোট গণনা করা হবে। এ নির্বাচনে ১৭৯ জন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। তবে ভিপি পদে একজনের প্রার্থিতা বাতিল ও জিএস পদে একজন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সেই হিসাবে জাকসুতে মোট ১৭৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বর্তমানে সহসভাপতি (ভিপি) পদে নয়জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নয়জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস-নারী) পদে ছয়জন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস-পুরুষ) পদে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের একাংশ মনোনীত সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদলের প্যানেলে জায়গা না পেয়ে প্যানেল ঘোষণার দিন বিদ্রোহ করে জিএস পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া। তবে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও ব্যালটে তার নাম থাকছে।
এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে নয়জন, পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সম্পাদক পদে ছয়জন, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে আটজন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে আটজন, সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে আটজন, নাট্য সম্পাদক পদে পাঁচজন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে তিনজন, সহক্রীড়া সম্পাদক পদে ছয়জন, তথ্য-প্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক পদে সাতজন, সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক পদে আটজন, সহসমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক (নারী) পদে সাতজন, সহসমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক (পুরুষ) পদে সাতজন, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক পদে সাতজন, পরিবহণ ও যোগাযোগ সম্পাদক পদে সাতজন, কার্যকরী সদস্য (নারী) পদে ১৬ জন ও কার্যকরী সদস্য (পুরুষ) পদে ২৬ জন লড়ছেন।
জাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়ছেন-আরিফ উল্লাহ আদিব, মো. শেখ সাদী হাসান, রাব্বি হোসেন, আরিফুজ্জামান উজ্জল, আব্দুর রশিদ জিতু, সোহানুর রহমান, রাব্বি হোসেন, আব্দুল মান্নান ও মাহফুজুল ইসলাম মেঘ। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে লড়ছেন-আবু রায়হান কবির রাসেল, মাজহারুল ইসলাম, তানজিলা হোসাইন বৈশাখী, মো. শাকিল আলী, জাহিদুল ইসলাম, আবু তৌহিদ মো. সিয়াম, শরন এহসান ও মো. তানবীর হোসেন। নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়ছেন আয়েশা সিদ্দিকা, আঞ্জুমান আরা ইকরা, লামিয়া রহমান তৈশী, ফারিয়া জামান, মালিহা নামলাহ্ ও সোহাগী সামিয়া জান্নাতুল ফেরদৌস। পুরুষ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়ছেন-রাকিবুল হক, ফেরদৌস আল হাসান, সজিব আহম্মদ, আল ইমরান, জিয়া উদ্দিন, সাজ্জাদউল ইসলাম, কাউসার আলম আরমান, নাজমুল ইসলাম, নূর এ তামীম স্রোত ও তৌহিদুল ইসলাম ভূঁঞা।