মহাকাশে দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের যাত্রা শেষে ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে অবতরণ বা ‘সফট ল্যান্ডিং’য়ের প্রথম লক্ষ্য আজ সফলভাবে অর্জন করছে, যা ভারতকে বিশ্বের এলিট ‘স্পেস ক্লাবে’ জায়গা করে দিল।
বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করল – আর চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারাই হল প্রথম দেশ।
গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযান-থ্রির এই যাত্রা শুরু হয়েছিল।
আজ বুধবার সন্ধ্যায় অবতরণের নির্ধারিত মুহুর্তটি সফলভাবে পার হয় কি না, তার জন্য কোটি কোটি ভারতবাসী অধীর উৎকন্ঠা নিয়ে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন – যেখানে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর দেওয়া অভিযানের প্রতিটি মুহুর্তর আপডেট লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছিল।
ভারত সন্ধ্যা ছ’টা বাজার মিনিটকয়েক পরেই সেই সফট ল্যান্ডিং সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা হতেই সারা দেশ উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় আতসবাজি ফাটানো ও মিষ্টি বিলি করা শুরু হয়ে যায় – অনেকেই তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা নাড়াতে শুরু করে দেন।
দক্ষিণ অফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এদিন লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে ইসরো-র মিশন সেন্টারে চন্দ্রযান অভিযানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
সফট ল্যান্ডিং সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মোদী ইসরোর বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানান এবং বলেন “এই মুহুর্তটি হল নতুন ভারতের নতুন উড়ান!”
তিনি আরও বলেন, “আজ নিউ ইন্ডিয়া বা নতুন ভারতের বিজয় ঘোষিত হল। এই মুহুর্তটি আসলে ১৪০ কোটি ভারতীয়র হৃদস্পন্দনের শক্তি!”
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন সংস্থা দূরদর্শন, প্রায় সবগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ইসরোর ওয়েবসাইট ও তাদের ফেসবুক ও ইউটিউব পেজে বিকেল সাড়ে পাঁচটার আগে থেকেই চন্দ্রযান-থ্রির শেষ ধাপের যাত্রার প্রতিটি মুহুর্ত লাইভ টেলিকাস্ট করা হচ্ছিল।
চন্দ্রযান-থ্রির ‘বিক্রম’ নামক ল্যান্ডারটি চাঁদের বুকে সফলভাবে নামতেই ইসরোর মিশন সেন্টারে বিজ্ঞানীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা অভিনন্দন জানাতে থাকেন। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যায় শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের বার্তায়।
এর আগে ২০১৯ সালে ভারতের চন্দ্রযান-টু মহাকাশযান চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিংয়ের লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
প্রায় চার বছর বাদে এসে চন্দ্রযান-থ্রি কিন্তু সেই লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হল।
এই অভিযানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি অবতরণ করেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে, যেখানে সম্প্রতি জলের অস্তিত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ও মনোযোগ এখন চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই অঞ্চলটিতেই।
এই সফট ল্যান্ডিংয়ের পর এখন পরবর্তী ১৪ দিন (যেটা এক চান্দ্র দিবসের সমান) ধরে চন্দ্রযান-থ্রির মুন রোভার ‘প্রজ্ঞান’ চাঁদের বুক থেকে নানা ছবি ও ডেটা পাঠাতে থাকবে।
চোদ্দ দিন পর প্রজ্ঞান রোভারের সক্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর কারণ এটির শক্তির উৎস হল সৌরশক্তি চালিত সোলার সেল – আর একটা পর্যায়ের পর ওই সেলগুলো সূর্যালোকের আড়ালে চলে যাবে।
এই দুসপ্তাহের মধ্যে চন্দ্রযান-থ্রি পর্যায়ক্রমিকভাবে একটার পর একটা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবে। যার মধ্যে চন্দ্রপৃষ্ঠে কী কী ধরনের খনিজ পদার্থ আছে, তার একটি স্পেক্ট্রোমিটার অ্যানালিসিসও থাকবে।
এই চন্দ্রযান মিশন – যা ভারতের ‘লুনার এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রাম’ নামেও পরিচিত – তার আওতায় ইসরোর বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত চাঁদের অভিমুখে মোট তিনটি মহাকাশযান পাঠিয়েছেন।
২০০৩ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রথমবারের মতো ভারতের লুনার এক্সপ্লোরেশন বা চন্দ্র অভিযানের কথা ঘোষণা করেন।
এরপর ২০০৮ সালে উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রযান-১, যা সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে বা লুনার অরবিটে প্রবেশ করেছিল। তখন অবশ্য দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং।
চন্দ্রযান-টু চাঁদে অবতরণের চেষ্টা করলেও সেই অভিযান কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান-টুর ল্যান্ডার বিক্রম যখন টাচডাউনের চেষ্টা করে, তখন ব্রেকিং সিস্টেমে কিছু অসঙ্গতির কারণে সেটি চাঁদের বুকে ক্র্যাশ করে।
এর ফলো-আপ হিসেবেই চন্দ্রযান-থ্রির পরিকল্পনা করা হয় – যার প্রধান লক্ষ্য ছিল চাঁদের বুকে নিরাপদে ‘সফট ল্যান্ডিং’ নিশ্চিত করা এবং তারপর চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো।
ইসরোর তথ্য অনুসারে, চন্দ্রযান-থ্রি অভিযানে মোট ৬১৫ কোটি ভারতীয় রুপি বা ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো খরচ হয়েছে।
এমন কী চার বছর আগেকার চন্দ্রযান-টুর চেয়েও অনেকটা কম খরচ হয়েছে এই অভিযানে।
এত কম খরচে পৃথিবীতে কোনও সফল মহাকাশ অভিযান লঞ্চ করার নজির খুব কমই আছে।
বস্তুত চন্দ্রযান-থ্রির খরচ হলিউডের বহু বিগ-বাজেট ও ব্লকবাস্টার ছবির নির্মাণের খরচের চেয়েও অনেক কম বলে বলা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক হলিউড মুভি ওপেনহাইমার তৈরির চেয়েও কম খরচে সম্পন্ন হয়েছে চন্দ্রযান-থ্রি। সমসাময়িক আর একটি ছবি ‘বার্বি’র নির্মাণে যা খরচ হয়েছে, তার মাত্র অর্ধেক লেগেছে এই মহাকাশ অভিযানে।
এই অভিযানটি ২০২০ সালেই পরিচালিত হবে বলে প্রথমে স্থির করা হয়েছিল, কিন্তু কোভিড মহামারির জন্য সেই পরিকল্পনা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
চন্দ্রযান-টুর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-থ্রিতে বেশ কিছু উন্নতি সাধন করেছিলেন, যাতে এবারে সফট ল্যান্ডিং একশোভাগ সফল হতে পারে।
ইসরোর অধিকর্তা, মহাকাশবিজ্ঞানী এস সোমনাথের কথায়, “আমাদের প্ল্যান এ কোনও কারণে বানচাল হলে তার জন্য প্ল্যান বি প্রস্তুত ছিল। এমন কী সেই ব্যাকআপেরও ব্যাকআপ তৈরি ছিল!”
এই মহাকাশযানের মোট তিনটি অংশ ছিল : একটি ল্যান্ডার মডিউল (এল এম), একটি প্রোপালশন মডিউল (পিএম) আর একটি রোভার।
বিক্রম নামে এই রোভারের নামকরণ করা হয়েছিল ভারতের প্রবাদপ্রতিম মহাকাশ বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে। ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইকে ভারতের মহাকাশ চর্চার পথিকৃৎ বলেও গণ্য করা হয়।
মৃত্যুর বাহান্ন বছর বাদে সেই বিক্রম সারাভাইয়ের নামাঙ্কিত মুন রোভারই ভারতকে মহাকাশচর্চার ইতিহাসে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিল।বিবিসি বাংলা।