বুধবার, ১২ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কেজি দরে বিক্রি শহীদ জননীর ব্যক্তিগত বই

বাংলা একাডেমির সংগ্রহে থাকা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত বই কেজি দরে বিক্রি-এই খবর প্রকাশের পরই একটি প্রশ্ন : আমরা আসলে কোন ইতিহাসের সন্তান, আর কোন ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ? প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বাংলা একাডেমিকে দায়িত্ব দিয়ে সংরক্ষণের জন্য দেওয়া বইগুলো এখন অনলাইন বই বিক্রির পেজে কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। ছাপার কালি শুকানোর আগেই যে বইগুলো একদিন একটি সংগ্রামী মায়ের হাত ছুঁয়ে ছিল, সেগুলো আজ পানির দরে চলে গেছে ফুটপাতের অচেনা ভিড়ে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এক ট্রাক পুরোনো বই কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা এই বইগুলো পেয়েছেন সাধারণ জঞ্জাল হিসেবে। বইয়ের ভেতরে এখনও বাংলা একাডেমির সিল, আর পাশে লেখা—“জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ।” যে বই একদিন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠার কথা ছিল, সেটিকে এখন এক প্যাক কাগজের মতো ওজন করে বিক্রি করা হচ্ছে। এ দৃশ্য শুধু দুঃখের নয়-এক ধরনের জাতীয় অবচেতন ভাঙনের লক্ষণ।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জানিয়েছেন-২০১৪ সালে একটি কমিটি “অতিরিক্ত” ও “অসংরক্ষণযোগ্য” বই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই তালিকার ভিত্তিতেই এসব বই বিক্রি হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে: একটি সাধারণ পুরোনো বইয়ের সঙ্গে কি জাহানারা ইমামের হাতে রাখা সংগ্রহশালার বই একই তুলনার হতে পারে? গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের নিয়ম রয়েছে-বিশিষ্ট ব্যক্তি, ঐতিহাসিক চরিত্র বা বিশেষ সংগ্রহের বই কখনোই বাতিল তালিকায় তোলা যায় না। আর তাই কণ্ঠশিল্পী ও গ্রন্থাগার পণ্ডিত সৈয়দ আব্দুল হাদী মন্তব্য করেছেন এটি “স্পষ্ট অন্যায়।”
যে বই মানুষ পড়তে গিয়ে ইতিহাসের স্পন্দন অনুভব করতে পারে, সেটি ‘অতিরিক্ত’ হতে পারে কীভাবে?

আরও উদ্বেগজনক হলো, বাংলা একাডেমি যেটুকু বই বিক্রির কথা স্বীকার করেছে, তার অন্তত দশগুণ বেশি বই বিক্রি হয়েছে অনলাইনে বা ফুটপাতে। অর্থাৎ বইগুলো কখন, কীভাবে, কার অধীন থেকে বেরিয়ে গেল-তার কোনো পরিষ্কার জবাব নেই। রাষ্ট্রের একটি শীর্ষ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যদি নিজের সংগ্রহের তালিকা থেকেও সরে যায়, তবে সেই অস্বচ্ছতার দায় শুধু প্রশাসনিক নয়, নৈতিকও।

জাহানারা ইমামের নাম শুনলেই আমরা একটি ভগ্ন হৃদয়ের দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচিত হই। রুমীর গুম হওয়া, যুদ্ধের আগুন, আর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তার আগুনে সংগ্রাম-সব মিলিয়ে তিনি এই জাতির আত্মসম্মানের প্রতীক। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নৈতিকতার শিখা উঁচু করেছিলেন এমন সময়ে, যখন অনেকেই নীরব থাকাই নিরাপদ মনে করত। তার মতো ব্যক্তিত্বের সংগ্রহশালার বই যদি কেজি দরে বিক্রি হতে পারে, তবে তা কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয়-এটি একটি জাতির স্মৃতিকে অবমাননা করার মতো ঘটনা।

সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম আলো যেভাবে ঘটনাটি খুঁজে বের করেছে-তা অন্যদেরও উৎসাহিত করেছে আলোচনায় যোগ দিতে। ইতিহাস, সাহিত্য, সংগ্রাম-এসবের প্রতি কতটুকু দায়িত্ব রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মানুষের ক্ষোভ খুব স্বাভাবিক: কারণ স্মৃতির প্রতি অবহেলা মানে ইতিহাসের প্রতি অবহেলা।

পুলিশ বা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সাধারণত তখনই আসে যখন অভিযোগ আনুষ্ঠানিক হয়। তবে বই নষ্ট, অপচয় বা বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারি সম্পদের ওপর তদন্ত হতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কোথায় গেল, কোন অনুমতিতে গেল-তার জবাবদিহি নিশ্চিত করাই প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব। বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন আজ খুব কঠিনভাবে সামনে এসেছে।

বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে “অতিরিক্ত”, “অসংরক্ষণযোগ্য”, “বাতিল তালিকা”-এসব যুক্তি দেওয়া হলেও তা মানুষের ক্ষোভ কমাতে পারেনি, কারণ মানুষ বইয়ের দাম নয়-তার মর্যাদার কথা ভাবছে। জাহানারা ইমামের বই কেজিতে বিক্রির দৃশ্য যেন আমাদের বলে দেয়, আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি কারা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়কে শব্দে তুলে এনে আলো দেখানোর পথ তৈরি করেছিলেন।

অবশেষে এই ঘটনাটি শুধু একটি বিক্রি হওয়া বইয়ের বিষয় নয়। এটি আমাদের ধরিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠান যদি স্মৃতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে স্মৃতি রক্ষার দায় এসে পড়ে মানুষের ওপর। আর মানুষ তখন প্রশ্ন তোলে: একদিন কি ইতিহাস জিজ্ঞেস করবে-তোমরা কেন চুপ ছিলে? আমরা তখন কি উত্তর দেব? যে আমরা দেখেছিলাম, ইতিহাস কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল-আর আমরা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।

লেখক: হাফিজ আল আসাদ,প্রচার সম্পাদক, ইতিহাস এলামনাই এসোসিয়েশন (CUHDA)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সর্বশেষঃ