পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পুকুরে কোরাল মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন আনোয়ার। তার সফলতার হাতছানির নেপথ্যে কাজ করেছে অদম্য ইচ্ছা ও প্রশিক্ষণ শেষে কোরাল মাছ চাষের উদ্যোগ
দেশী প্রজাতির কোরালের খাবার তেলাপিয়া ও চিংড়ি সহ অন্যান্য মাছ। মৎস্য চাষীরা ঘেরে বা পুকুরে কোরাল চাষ করলে অন্যান্য প্রজাতির মাছ খেয়ে সাবার করতো। ফলে চাষিদের লাভের বদলে গুনতে হতো লোকসান। তবে এই প্রথমবারের মতো রাক্ষসী এসব মাছ কৃত্রিম ফিড খাবারের মাধ্যমে বানিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে পুকুরে।
প্রায় এক বছর আগে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের মৎস্য চাষী আনোয়ার (৫০) মাইটভাঙ্গা গ্রামে নিজের ৩০ শতাংশ জমির মিঠা পানির পুকুরে কোরাল চাষ শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষনার পর সাসটেইনেবল কোষ্টাল এন্ড মেরিন ফিশারীজের একদল গবেষক থাইল্যান্ড থেকে ৭ শতাধিক পোনা আমদানি করে এ মৎস্য চাষীকে সরবারহ করেন। কোরালগুলোকে খাদ্য হিসেবে দেয়া হয়েছে গবেষকদের উৎপাদিত সিউইড সমৃদ্ধ কৃত্রিম ফিড খাবার। সঠিক পরিচর্চায় মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আনোয়ারের পুকুরের এক একটি কোরালের ওজন হয়েছে ৩ থেকে ৪ কেজি। এতে অনেকটা উচ্ছসিত আনোয়ার। তার দেখাদেখি এখন অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন কোরাল চাষে। তবে বর্তমানে কক্সবাজারেই উৎপাদন হচ্ছে এসব কোরাল মাছের পোনার। যে কেউ চাইলেই কক্সবাজার থেকে এসব কোরালের পোনা সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছে গবেষকরা।
মৎস্য চাষী আনোয়ার বলেন, আমরা আগে পুকুরে কোরাল চাষের কথা কোনভাবে চিন্তাও করতাম না। কারন কোরাল হলো রাক্ষসী মাছ। পুকুরে একটি দুইটি কোরাল থাকা মানে অন্য সব মাছ শেষ। তবে আমি এই প্রথম পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের পরামর্শে আমার পুকুরে গত বছর কোরাল চাষ শুরু করি। তারা আমাকে থাইল্যান্ডের ৭ শতাধিক পোনা দিয়েছে। এখন আমার পুকুরের এক একটি কোরালে ওজন ৩ থেকে ৪ কেজি হয়েছে। আমি খাবার হিসেবে এসব কোরাল মাছগুলোকে গবেষকদের উৎপাদিত ফিড খাবার এবং বাজার থেকে কিনে আনা ফিড খবার দিয়েছি। আশা করছি ব্যাপক লাভবান হবো।
মাইটভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা হোসেন মিয়া বলেন, আনোয়ার পুকুরে কোরাল চাষে ব্যাপক লাভবান হবে, কারন তার এক এটি কোরাল ৩ থেকে ৪ কেজি ওজন হয়েছে। এ জাতের পোনা পেলে আমরাও পুকুরে কোরাল চাষ করবো।
একই এলাকার অপর বাসিন্দা রহমান মিয়া বলেন, এটি একটি আশ্চর্যের বিষয়। দেশী কোরাল কখনো ফিড খাবার খায়না। পুকুরের অন্যান্য মাছ খেয়ে কোরাল বেড়ে ওঠে। তবে আনেয়ার শুধু ফিড খাবার দিয়েই কোরাল বড় করে তুলেছে। আমি পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে এ জাতের কোরাল চাষ করবো।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও সাসটেইনেবল কোষ্টাল এন্ড ফিসারীজ প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল চাষ ছড়িয়ে দিতে দীর্ঘ গবেষনা করা হয়েছে। এমনকি এসব মাছের খাবার বিশ্ববিদ্যালয় বসেই মেশিনের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়েছে। এসব মাছের খাবারে সামুদ্রিক শৈবাল (সিউইড) ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে তাঁর দল কাজ করছেন। ৫ গ্রামের কোরাল মজুদ পুকুরে ১ বছরে চাষ করে ২ থেকে ৩.৫ কেজি ওজনের হওয়ায় শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যচাষীগণের কাছে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন তাঁদের উদ্ভাবিত সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ প্রযুক্তি বাংলাদেশে কোরাল মাছের উৎপাদন তথা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোষ্টাল এন্ড ফিসারীজ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক শরিফুল আজম বলেন, দেশের উৎপাদিত পোনা মূলত তৈরী খাবার না খাওয়ার কারনেই থাইল্যান্ড থেকে এসব পোনা আমদানি করা হয়েছে। তবে দীর্ঘ গবেষনার পর কৃত্রিম খাদ্যের কোরালের পোনা বর্তমানে কক্সবাজারের কয়েকটি হ্যাচারীতেও উৎপাদিত হচ্ছে। চাষীরা চাইলে সেখান থেকেও কোরালের পোনা নিয়ে আসতে পারবে। উপকূলীয় এলাকায় আমরা ফিড খাবারের কোরাল চাষ নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করেছি। এটির পোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে বড় করা পর্যন্ত সফলতা পাওয়া গেছে।