শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের পর বিগত ২৫ বছরে সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর ও সংস্থার মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি দফতর হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি দিবস। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের এই দিনে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। এ বছর পালন হচ্ছে শান্তি চুক্তির ২৫ বছর অর্থাৎ রজতজয়ন্তী।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর পাহাড়ে অশান্তি শুরু হয়। জনসংহতি সমিতির কার্যক্রমে অন্ধকার নেমে আসে। জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভারতে পালিয়ে যায়। ত্রিপুরায় ঘাঁটি স্থাপন করে শান্তি বাহিনীকে সামরিক দিক দিয়ে সুসংগঠিত করতে থাকে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান জোরদার করে পুরো পার্বত্য অঞ্চলকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে নিয়ে আসে। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনসংহতি সমিতিকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে পাল্টা অভিযান শুরু করে। পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠে। অস্থিরতার কারণে একটি সময়ে পাহাড় রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেখানে সাধারণ মানুষের চলাচল দুরূহ হয়ে পড়ে। পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের কারণে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়।
অশান্ত রক্তাক্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকার কেউই কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত কিংবা বসবাস প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের বিরাট একটি জনপদকে অশান্ত রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সে অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে উদ্যোগী হন এবং সে বছরের অক্টোবরেই জাতীয় সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে খাগড়াছড়ির সার্কিট হাউসে সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্য থেকে সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রেখে উপজাতীয় জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়।
প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সপ্তম বৈঠকেই জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতি চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছে যায়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা, বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে সভাপতি ও শান্তি বাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াত দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেয়। দেশ ভাগের জুজু তোলে জনগণকে ভুল বোঝাতে থাকে। খালেদা জিয়া তো বলেই দিলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ফেনী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের সঙ্গে চলে যাবে। পরিস্থিতি অশান্ত করতে ঢাকা থেকে লংমার্চ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গাড়িবহর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। শান্তি চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করা হয়। এমনও প্রচার করা হয় চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে বাঙালিদের যাতায়াত ও বসবাসের অধিকার থাকবে না। এসব অপপ্রচারে সাময়িক হলেও কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় স্পষ্ট হয়েছে, তাদের অভিযোগ ও অপপ্রচার ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক। বরং শান্তি চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব আরও মজবুত হয়েছে।
শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের পর বিগত ২৫ বছরে সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর ও সংস্থার মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি দফতর হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
শান্তি বাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা করে ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক বিল-২০১০ সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায়ই ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দফতরে ক্ষুদ্র -নৃগোষ্ঠী ব্যক্তিদের কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে পাহাড়ের তিন জেলায় অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। গহিন অরণ্যেও পৌঁছে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। শান্তি চুক্তির আগে এডিপিভুক্ত প্রকল্প ছিল মাত্র একটি, এখন সেখানে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল করতে ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। সবাইকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে পাহাড়ের তিন জেলায় প্রায় তিন হাজার কিমি বিদ্যুৎ লাইন তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বিদ্যুৎ লাইন সম্ভব হয়নি, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫০ হাজার পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের সুবিধায় আনা হয়েছে। রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট, বান্দরবানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার অধিকাংশ উপজেলায় আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ইউএনডিপির ২৬৪ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করাসহ আরও বহুবিধ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ অবকাঠামো উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক এবং মানবিক কার্যক্রমে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে। পাহাড়ের যেখানেই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয় সেখানেই সেনাবাহিনী মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, দুর্গম এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে স্কুল নির্মাণ, নিরাপদ স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিকভাবে তাদেরকে স্বাবলম্বী করতে সেনাবাহিনী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করে যাচ্ছে।
এখন পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই শহরের নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই গড়ে উঠছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পটসহ বিনোদন কেন্দ্র। খাগড়াছড়ির সাজেক, বান্দরবানের নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়, বগালেক, কেওক্রাডং, নীলাচলসহ রুমা ও থানচি এলাকার সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত শুধু দেশেরই নয়, ভ্রমণপিপাসু বিদেশি পর্যটকদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
আজও অনেকেই শান্তি চুক্তি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে, যা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শান্তি চুক্তির অধিকাংশ শর্তই পূরণ হয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বসে নেই। বাকি চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন বেগবান করতে সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক করে ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তিন সদস্যবিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। তারপরে কমিটি বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক মন্ত্রণালয় অসম্পন্ন চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই দীর্ঘদিনের সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। একসময়ের অশান্ত পাহাড় আজ শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছে। এর একমাত্র কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তিনিই অশান্ত পাহাড়ে শান্তির রূপকার।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, সদস্য, সম্প্রতি বাংলাদেশ